শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
শেখ হাসিনা ও শিনজো আবে বৈঠক, ২৫০ কোটি ডলারের চুক্তি

বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবে জাপান

জাহাঙ্গীর আলম, টোকিও থেকে

বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবে জাপান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিনজো আবে গতকাল জাপানে -বাসস

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ যে স্বপ্ন  দেখছে তা পূরণে জাপানের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। গতকাল  টোকিওতে জাপান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা জানান। যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এ লক্ষ্য পূরণে জাপান আমাদের পাশে থাকবে ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে যাবে বলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আমাকে নিশ্চিত করেছেন। বৈঠকের পর শিনজো আবে ও শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে আড়াইশ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। জাপানের সঙ্গে করা আড়াইশ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তির অর্থে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে (৫) অর্থায়ন করা হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে ৬টায় জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। এ সময় সুসজ্জিত একটি দল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেয়। এরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে দেওয়া জাপানের প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা।  শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক প্রমুখ। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনার এটাই প্রথম জাপান সফর। চুক্তি স্বাক্ষরের পর যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জাপানের জন্য বিশেষ জায়গা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। স্বাধীনতার পর থেকেই জাপানের সহায়তার কথাও তিনি স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জাপানের ঐতিহাসিক উন্নয়ন থেকে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারি যে, সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এখন আমরা সঠিক পথ ধরেই এগিয়ে চলেছি। শেখ হাসিনা বলেন, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, জাপান সব সময় আমাদের পাশে আছে। শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারণ করার বিষয়ে বেশকিছু নতুন ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছি। সম্ভাব্য যেসব ক্ষেত্র থেকে দুই দেশই লাভবান হতে পারে তা উদ্ভাবন করার বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন বলে জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশ ও জাপান একে অপরের প্রতি সহযোগিতা বৃদ্ধি করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মানবিক ও রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে টেকসই ও দ্রুত সমাধানের উপায় খোঁজার ব্যাপারে আমি ও আবে আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি জাপান অনুভব করতে পারছে এবং মিয়ানমারের প্রয়োজন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। আজ ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ সম্মেলনে তিনি এশিয়ার সম্ভাবনা ও উত্থান নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরবেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও তাত্ত্বিকদের সামনে।

জাপানি ব্যবসায়ীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী : বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্পর্কের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে জাপানের ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে হোটেল নিউ অটানিতে বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরামের (বিজেবিএফ) বৈঠকে তিনি দুই দেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ককে উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।

জাপানের ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার নেত্বত্বে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে নেওয়া বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করেন। তিন বছর আগে ২০১৬ সালে জাপান সফরের সময় জাপানের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এরপর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে এবং জাপানের অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে ব্যবসায় আগ্রহী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, কাক্সিক্ষত সেই লক্ষ্যে স্থিতিশীলভাবেই আমরা এগিয়ে চলেছি। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণে সঠিক পথেই রয়েছি আমরা। শেখ হাসিনা জানান, তার সরকারের নেওয়া সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি খাতের জন্য স্থিতিশীল নীতি সহায়তা এবং অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাংলাদেশের সফলতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাপক শিল্প বিস্তারের ফলে পাঁচ বছরের মধ্যে রপ্তানি দ্বিগুণ হয়ে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দ্য ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল সোর্সিং কান্ট্রি, পণ্য উৎপাদন ও বিতরণ হার এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি হওয়া অর্থনীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছে। গত বছর বাংলাদেশে জাপান টোব্যাকোর ১৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে শেখ হাসিনা জাপানের ব্যবসায়ীদের বলেন, আমরা এ ধরনের আরও বিনিয়োগ দেখতে আগ্রহী। বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং দেশি, বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের রয়েছে অন্যতম উদার বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে আইন করে বিদেশি বিনিয়োগের সুরক্ষার ব্যবস্থা, কর সুবিধা, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা, শতভাগ বিদেশি ইক্যুইটির সুবিধা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার মতো বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারের সুবিধার কথা তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনা বলেন, তৈরি পোশাক খাতে আমাদের সফলতা বিশ্ববাসীর জানা আছে। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ থেকে জাপানে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। আমরা রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করছি। এজন্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য নতুন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পও বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইউরোপের দেশসহ বিশ্বের ১৪টি দেশে বাংলাদেশ থেকে পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ রপ্তানি হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আরেকটি প্রতিশ্রুতিশীল খাত হলো সফটওয়্যার। দেশের ৮০০ আইটি ও সফটওয়্যার কোম্পানির মধ্যে ১৫০টির বেশি কোম্পানি বিদেশি গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি আইটি পেশাদার বিশ্বের নামকরা কোম্পানি যেমন- মাইক্রোসফট, ইনটেল, আইবিএমে কাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তৈরি চামড়াজাত পণ্য, কৃষিভিত্তিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য বিশ্ববাজারের নজরে রয়েছে।

পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জাপানের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন। অনুষ্ঠানে জাপানের নয়জন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী বক্তব্য দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জাপান-বাংলাদেশ কমিটি ফর কমার্শিয়াল অ্যান্ড কো-অপারেশনের চেয়ারম্যান টেরাও আসাদা, জাইকার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেত্রোর, সুমিহিতো করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইও, মিৎসুই অ্যান্ড কোং লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, সোজিৎস করপোরেশনের সিনিয়র ম্যানেজিং এক্সিকিউটিভ অফিসার, মিৎসুবিসি মোটরসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, হোন্ডা মোটরসের ম্যানেজিং অফিসার এবং মারুহিসা করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। অনূদিত বই অনুষ্ঠানে বিতরণ করা হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ এবং জাপানস এনার্জি ফর নিউ এরার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। গতকাল টোকিওতে হোটেল নিউ অটানিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ সমঝোতা স্মারক সই হয়।

 

সর্বশেষ খবর