বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

চট্টগ্রাম ও সিলেটবাসীর অপরাধটা কী?

পীর হাবিবুর রহমান

চট্টগ্রাম ও সিলেটবাসীর অপরাধটা কী?

সেনাশাসন জমানার অবসান শেষে গেল শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, তখন গণতন্ত্রের নবযাত্রায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায়। দেশে একটি উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সে সময় ‘৯৪ সালের শুরুতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনে প্রথম সরাসরি ভোটের নির্বাচন। শাসক দল বিএনপির সঙ্গে প্রার্থী দিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে সুসংগঠিত ঐক্যের ওপর ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দলের শীর্ষ নেতারা চারটি সিটি করপোরেশনে দায়িত্ব নিয়ে টিম গঠন করে নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ভোটের প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। এমন উৎসবমুখর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ঢাকাবাসী আর কখনো দেখেনি। সে সময় ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপির মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে। ভোটের যুদ্ধে মেয়র হানিফ তার বাগ্মিতায় ভোটারদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিলেন। আমরা তখন মাঠের রিপোর্টার। কি তুমুল উত্তেজনা তখন! ভোটার, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সে কি আকর্ষণ! এখনো চোখের সামনে ভাসে। সেই ভোটে ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দেড় লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন মরহুম মোহাম্মদ হানিফ। চট্টগ্রামে বিএনপির মীর নাছির উদ্দিনকে পরাজিত করে রাজনীতিতে নায়কের মতো উঠে আসেন মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। খালেদা জিয়ার শেষ শাসনামলেও তিনি বিশাল ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীকে টানা তৃতীয়বারের মতো পরাজিত করেছিলেন। সেই ‘৯৪ সালের চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ বিজয়ের হাসি হেসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার জনমতকে দৃশ্যমান করেছিল। খুলনায় বিএনপির তৈয়বুর রহমান আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। অন্যদিকে রাজশাহীতে ব্যাপক জনপ্রিয় মিজানুর রহমান মিনুর কাছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তখন দেশে চারটি বিভাগে চার সিটি করপোরেশন। সরকার ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিল। চট্টগ্রামে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, রাজশাহীতে মিজানুর রহমান মিনু ও খুলনায় তৈয়বুর রহমানকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়। মেয়রদের ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকার মেয়র হানিফের ‘জনতার মঞ্চ’ আর চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরীর অগ্নিমুখর আন্দোলন শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকে গণঅভুত্থানে পরিণত করেছিল। ‘৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মেয়রদের সেই মর্যাদা অব্যাহত রেখেছিল। ২০০১ সালের বিএনপি জমানায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে ঢাকার মেয়র হন সাদেক হোসেন খোকা। তিনিও পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার ঢাকাকে দক্ষিণ ও উত্তর- দুই ভাগে বিভক্ত করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দক্ষিণে সাঈদ খোকন ও উত্তরে আনিসুল হক বিজয়ী হন বিএনপিকে পরাজিত করে। যদিও নির্বাচনের দিন বিএনপি ভোট বর্জন করেছিল। নির্বাচনের পর বিজয়ী দুজনকেই পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলেও চট্টগ্রামে বিজয়ী আওয়ামী লীগ দলীয় আ জ ম নাছিরের ভাগ্যে এখনো প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা জোটেনি। দলের দুঃসময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতৃত্বে আসা আ জ ম নাছির মেয়র হওয়ার পর আগের মেয়রদের মতো কেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পাচ্ছেন না- এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে প্রশ্ন, ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে।

সিলেটে বিএনপির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে টানা দুবার পরাজিত করে তুমুল লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে, নগরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালালেও, মানুষের প্রশংসা জুটলেও, জেল খাটলেও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা জোটেনি। সাবেক মেয়র কামরান প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। আরিফ কেন পাবেন না- এ নিয়ে নগরবাসীর অসংখ্য প্রশ্ন, হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে।

কুমিল্লায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দুবার মেয়র পদে বিজয়ী বিএনপির মনিরুল হক সাক্কুকে উপমন্ত্রীর মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। রংপুরে তুমুল ভোটযুদ্ধে বিশাল গণরায় নিয়ে মেয়র হওয়া জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার ভাগ্যেও প্রতি বা উপমন্ত্রীর মর্যাদা জোটেনি। বরিশাল সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে মেয়র হলেও তাকে কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়নি। গাজীপুরে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক দক্ষতা, জনপ্রিয়তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হয়েছেন অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম। তাকেও এখন পর্যন্ত উপমন্ত্রীর মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ইকরামুল হক টিটু। নগরবাসীর প্রত্যাশা থাকলেও এখন পর্যন্ত একটি উপমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন কিনা- সে প্রশ্ন রয়েছে।

ঢাকা উত্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোটারহীন উপনির্বাচনে বিজয়ী মেয়র আতিকুল ইসলামকে তার পূর্বসূরির রেওয়াজ অনুযায়ী পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে খুলনার তালুকদার আবদুল খালেক ও রাজশাহীর এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকেও তাদের পূর্বসূরিদের মতো প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম ও সিলেটের মেয়রদের তাদের পূর্বসূরিদের মতো মর্যাদা দেওয়া হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব ড. সা’দত হোসাইনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ নিয়ে। তিনি বলেছেন, মেয়রদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর মর্যাদাদান সরকারের সম্পূর্ণ এখতিয়ারভুক্ত। সরকার প্রয়োজন মনে করলে দিতে পারে। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের মেয়রদের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ও আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট নগরবাসীর অপরাধ কোথায়? সব মেয়রই তাদের নগরবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের মর্যাদার সঙ্গে নগরবাসীর মর্যাদা জড়িয়ে রয়েছে। যেমন তাদের দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে রয়েছে নগরের উন্নয়ন কর্মকান্ডে র সম্পর্ক। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোটের মেয়র পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা পাবেন আর তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী মেয়ররা প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর মর্যাদাও পাবেন না- এটি কেমন ন্যায়বিচার? কাউকে কাউকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হবে আর কাউকে কাউকে মর্যাদা দেওয়া হবে না- এটি বৈষম্যমূলক। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচিত মেয়ররা মর্যাদার দিক থেকে কেউ কারও থেকে কম নন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামকেও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা উচিত। চট্টগ্রাম ও সিলেটের মানুষের এবং প্রবাসীদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান যেমন অস্বীকার করার সুযোগ নেই তেমন অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মানুষের প্রত্যাশা অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই। নির্বাচিত মেয়রদের মর্যাদা দেওয়া মানে ওইসব সিটি করপোরেশনের ভোটারদেরও সম্মান ও মর্যাদাদান। কেউ পাবেন কেউ পাবেন না- এ বৈষম্য চলতে পারে না। এ নিয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।

সর্বশেষ খবর