রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডান-বামের বৃহত্তর ঐক্য চায় বিএনপি

শফিউল আলম দোলন ও মাহমুদ আজহার

ডান-বামের বৃহত্তর ঐক্য চায় বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর আবারও সরকারবিরোধী ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তোলার কথা ভাবছে বিএনপি। লক্ষ্য হলো, মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায়। একই সঙ্গে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিও চায় দলটি। এ ছাড়া কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, সরকারের ‘অনিয়ম’, ‘দুর্নীতি’ ও ‘দুঃশাসনের’ বিরুদ্ধেও দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলবে বিএনপি। এ কারণেই সরকারবিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য চায় দলটি।

জানা গেছে, ঈদের পর থেকেই ডান, বামসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করবে বিএনপি। এরই মধ্যে ভিতরে ভিতরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে ২০ দলের শরিক জামায়াতকে বাদ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে জোটকে অকার্যকর করে শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগোবে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোও থাকবে বৃহত্তর ঐক্যের অগ্রভাগে। 

সূত্র জানায়, বামপন্থি বড় দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে কথা বলতে বিএনপি সমর্থক একজন বুদ্ধিজীবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের আত্মীয় ওই বুদ্ধিজীবী এ নিয়ে কথাও বলেন। এ ছাড়াও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চায় থাকা ছয়টি দলের কয়েকটির সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-মার্কসবাদী)- এ ছয়টি দল নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা। অন্যদিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ ডানপন্থি কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানান, রাজপথের আন্দোলনকে সামনে রেখেই বিএনপি ঘর গোছানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জোটের শরিক দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত পার্টিগুলোকেও দল গোছানোর পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। ঈদুল ফিতরের পর এই বৃহত্তর ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। কোরবানির ঈদের আগে দল গোছানোর পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। কোরবানির ঈদের পরপরই রাজপথমুখী হবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জোট।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আর মানুষের মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করার দরকার আমরা তার সবকিছুই করতে প্রস্তুত। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বৃহত্তর প্লাটফর্ম তৈরি করে আমরা এই সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়ব।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। রাজপথের আন্দোলনেই একমাত্র মুক্তি মিলবে বিএনপি প্রধানের। তাছাড়া পাঁচ এমপির শপথে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, সেটাও হচ্ছে না। বিএনপির নেতা-কর্মীরা চায় দুর্বার আন্দোলন। বিএনপিও এখন সেটাই ভাবছে।

জানা যায়, ভোটের আগেই জাতীয় বৃহত্তর ঐক্য করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে প্রস্তাব উঠে। সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকেই এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। ওই সময় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জামায়াত বাদ দেওয়ার কথা বলেন। বিএনপি এতে আপত্তি করেনি। কিন্তু নির্বাচন দোরগোড়ায় চলে আসায় সবাই ভোটের মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন জোটফ্রন্টকে নিয়েই নির্বাচন করে বিএনপি। এরপর শোচনীয় পরাজয় ঘটে বিএনপি জোটের। ভোটের আগের সেই প্রস্তাব ধরেই সামনে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে এ বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। ২০ দলীয় জোট থেকে এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, বিজেপিসহ কয়েকটি দলকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার আভাস দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আশা করছি ঈদের পর ঐক্যফ্রন্টের পরিধি বাড়বে। এটা ধরে নিতে পারেন, সরকারবিরোধী গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলোকে নিয়ে আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও আগামী দিনে সুষ্ঠু নির্বাচনই আমাদের লক্ষ্য।’ বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে মাইনাস করতে দলের নীতিনির্ধারকদের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ বাড়ছে। বিএনপির বড় একটি অংশও চায় না এই মুহূর্তে জামায়াত জোটে থাকুক। জামায়াত জোটবদ্ধ হওয়ার কারণে সরকারবিরোধী প্রায় একযুগের আন্দোলন সংগ্রামেও বিএনপিকে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। তাই দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই চান, জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দিতে। বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে বিএনপি সেই পথেই হাঁটছে। আনুষ্ঠানিকভাবে জোটকে বাদ না দিলেও বৃহত্তর ঐক্যে জামায়াতকে বাইরে রাখা হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জামায়াত এখন বিএনপির গলার কাঁটা। আমরা জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা বলছেন, সারা দেশের মানুষ আজ চরমভাবে অতিষ্ঠ। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এই দেশব্যাপী ব্যাপক হারে দুর্নীতি-লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে আজ লুটপাট বা দুর্র্নীতি হচ্ছে না। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি লুটপাট-দুর্নীতি চলছে এখন সর্বত্র। অথচ কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এই অনাচার চলতে পারে না। সম্মিলিতভাবেই বন্ধ করতে হবে এই অন্যায়, অনাচার, দুর্নীতি ও গণ-লুটপাট। দুঃশাসনের পরিবর্তে সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস মিথ্যা মামলায় সাজানো রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন বয়স্ক মহিলাকে কারাগারে বন্দী রাখাটা কোন আইনের শাসন? আবার সরকার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই অন্যায়ের পক্ষে সমর্থন দিয়ে দম্ভের সঙ্গে বলা হয়, আজীবন তাকে জেলে থাকতে হবে। গণফোরাম সভাপতি ও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারকে বলছি, দ্রুত নির্বাচন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। সংবিধান লঙ্ঘন করে যে সরকার জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো বুক চেপে বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে হবে। কারণ এরা ইচ্ছামতো দেশ চালাচ্ছে, মানুষকে চরম অবজ্ঞা করছে। আমি মনে করি, সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবার ঐক্যের জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় এই অনাচারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন অপরিহার্য। তবে তার নেতৃত্ব কে বা কারা কীভাবে দেবেন সেটি আগে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ ঘরের মধ্যে এসি রুমের ভিতরে বসে রাজপথ ছাড়ি নাই স্লোগান দিলে আন্দোলন হবে না। নেতৃত্ব দিতে হলে আপনি যে-ই হোন না কেন, আপনাকে অবশ্যই রাজপথে নামতে হবে। আর রাজপথ ছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধানও সম্ভব নয়।’

সর্বশেষ খবর