সোমবার, ৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঈদুল ফিতর

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ঈদুল ফিতর

আগামীকাল শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে পরশু ঈদুল ফিতর। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আবার ঘটবে মাহে রমজান-পূর্ব জীবনযাত্রায় প্রত্যাবর্তন। ঈদ শব্দটি  এসেছে ‘এদো’ ধাতুমূল থেকে, যার অর্থ ফিরে আসা। আত্মশুদ্ধির দ্বারা খোদার রহমত ও মাগফিরাত অর্জনের নিমিত্তে একটি বিশেষ পরিপালনীয় পদ্ধতিতে কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে এক মাস ফরজ রোজা পালনের পরিতৃপ্তি সহকারে স্বাভাবিক জীবনাচারে ফিরে যাওয়ার এই ঈদের দিনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। ঈদ দিবসের ব্যবহারিক অর্থ তাই খুশির দিন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে, হযরত নবী করিম (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই খুশির দিন থাকে। আর আমাদের খুশির দিন হলো ঈদুল ফিতরের দিন।’ সুদীর্ঘ এক মাস কঠোর সংযম ও কৃচ্ছ্র সাধনের  পর পরিতৃপ্তিবোধ জেগে ওঠে সবার মনে। আর তার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে ঈদের দিনে নতুন পোশাক পরিধানে, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবই এক কাতারে একত্রে ঈদের নামাজে শামিল হওয়ায়, নামাজ শেষে পারস্পরিক কোলাকুলিতে আর পরিচিত অপরিচিত জনে বিশেষ আপ্যায়িত হওয়ার মধ্যে। সবাই যাতে এ আনন্দ উৎসবে শরিক হতে পারে সে কারণে এতিম ও দুস্থ দরিদ্রজনকে ঈদের নামাজের আগে জাকাত  ফিতরা দানের বিধান রয়েছে। আর সে কারণে মাহে রমজান শেষের ঈদ উৎসবকে শরিয়তের পরিভাষায়  ঈদুল ফিতরও বলা হয়ে থাকে। মুসলিম বিশ্বের অপর আরেকটি ঈদ উৎসব পবিত্র হজ পালনের সময় উদযাপিত হয় বলে তা ঈদুল আজহা নামে পরিচিত। ঈদ সারা বিশ্বের মুসলমানের সার্বজনীন আনন্দ উৎসব।

ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম তিনটি হলো রোজা, হজ ও জাকাত। এ তিনটি ভিত্তির মর্মবাণী সামাজিক সাম্য, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা এবং স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমত সম্পর্কে সুগভীর উপলব্ধি। ইসলামের দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) পালনের সঙ্গে রোজা হজ ও জাকাতের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। আর সে কারণে ইসলামে ঈদ উৎসব পালন একটি নিছক আনন্দ বিনোদনের পর্ব নয় এর মধ্যে নিহিত আছে সামাজিক দায়িত্ব পালন ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পালনের তাগিদ। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার যথার্থ সমাপনান্তেই ঈদের আনন্দ প্রকৃত রূপলাভ করে, সাদাকাতুল ফিতরা ও জাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিজের আনন্দ বিলিয়ে দেওয়ার আসমানি তাগিদ পালনের সুবর্ণ সুযোগ মিলে। একই সঙ্গে পবিত্র হজ পালনের সাফল্য সার্থকতার পাশাপাশি আল্লার রাহে নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উৎসবে অন্যের সঙ্গে নিজের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ প্রচুর। অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পালিত উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে ইসলামের ধর্মীয় উৎসবের মৌল পার্থক্য এখানে।

মাহে রমজানের শেষে শাওয়ালের চাঁদ দেখে সে মাসের প্রথম দিন মুসলিম মিল্লাত ঈদগাহে অথবা মসজিদে সমবেত হয়ে মহা আনন্দ ও উল্লাসে ধনী-দরিদ্র, আমির ফকির, ছোট বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মিলিতভাবে ছয় তাকবিরের সঙ্গে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করে। এ নামাজের সময় সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত। কেউ কোনো বিশেষ কারণে ঈদের নামাজ আদায় করতে না পারলে এর কোনো কাজা করতে হয় না, কেননা ঈদের নামাজের কোনো কাজা নেই। ঈদুল ফিতরের সুন্নাত কাজসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য- মিসওয়াক করা, নামাজের পূর্বে গোসল করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, চোখে সুরমা লাগানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা। ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টান্ন গ্রহণ করা, ঈদের মাঠে যাওয়ার আগে সাদাকায়ে ফিতরা আদায় করা, ঈদগাহে যে পথে যাবে, নামাজ শেষে অন্য পথে আসা, যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, ঈদগাহে যাওয়ার পথে নিম্ন স্বরে ‘আলাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ পড়তে পড়তে যাওয়া, এ দিন সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের বন্দোবস্ত করা ও প্রতিবেশী ইয়াতিম মিসকিন, গরিব-দুঃখীকে পানাহার করানো। ঈদের দিনে ঈদ মোবারক আস সালাম অভিবাদনে মশগুল হবে সবাই। কিন্তু এ অভিবাদন যাতে গতানুগতিক ও নিছক নিষ্প্রাণ অভিবাদনে পর্যবসিত না হয়, অন্তরের কূটিলতা জিইয়ে রেখে পরস্পরের ভেদাভেদ, অবনিবনা ভুলে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রকাশের মর্মবাণী যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ দিনের দাবি অপর মুসলমানকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং পরস্পরকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করা। আল কোরআনে যেমন বলা হয়েছে- ‘তোমাদের যখন অভিবাদন করা হয় তখন তোমরাও তা থেকে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা তারাই অনুরূপ করবে; আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা। আয়াত ৮৬)’ ‘রহমানের বান্দা তারাই যারা নম্রভাবে চলাফিরা করে পৃথিবীতে এবং তাদের যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’ (সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৩)। ঈদের দিন আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়া, তাদের খোঁজখবর নেওয়া কর্তব্য। যদি কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ এবং মনোমালিন্য থাকে তবে তা ঈদের পূর্বেই মিটিয়ে ফেলা উচিত, যেন ঈদের দিন ভ্রাতৃত্ববোধের যথাযথ বিকাশে পরস্পরকে আলিঙ্গন প্রকৃতপক্ষে অর্থবহ হয়। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এই হোক এবারের ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। ঈদ মোবারক আস সালাম।

লেখক : সাবেক সচিব ও এন বি আর চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর