শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ব্যবসা ও বিনিয়োগমুখী বাজেট আসছে

মানিক মুনতাসির

ব্যবসা ও বিনিয়োগমুখী বাজেট আসছে

ব্যবসা-বিনিয়োগ ও আর্থিক খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে জনবান্ধব বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ইতিমধ্যে তিনি একাধিকবার জানিয়েছেন আবাসন, শেয়ারবাজার, রপ্তানি খাতে থাকছে নগদ প্রণোদনার ঘোষণা। কমানো হতে পারে করপোরেট কর হার। আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে রাস্তাঘাট, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, করকাঠামোর পুনর্বিন্যাস, আর্থিক ও শিক্ষা খাতের সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির সুখবর দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ সমাপ্ত করতে থাকছে বিশেষ নির্দেশনা। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিদেশে নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির জন্য সরকারি বেসরকারি উভয় পক্ষকেই জোর তৎপরতা চালাতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে যদি কেউ নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তাহলে তাদেরকে বিভিন্ন রেয়াতি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে- এমন ঘোষণা থাকবে আসন্ন বাজেটে। আসন্ন বাজেটে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ধরা হচ্ছে। যদিও চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষি খাতের বাম্পার ফলন আর উচ্চ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করে সরকার। এ ছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক  ৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আসছে বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এডিপির আকার ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। যা ইতিমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। এবার বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটি হবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট। আর বর্তমান সরকারের টানা ১১তম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট এটি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে এই বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।

ব্যাপক পরিবর্তন হবে করকাঠামোতে : নতুন ভ্যাট আইন-২০১২ আগামী ১ জুলাই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য করকাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ের শুল্ক কাঠামো। যেমন গাড়ি, বিলাসবহুল পণ্য, প্রসাধনী, চকলেট এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে করকাঠামোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে করপোরেট করহার কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে। তবে সরাসরি ভোক্তাকে আঘাত করতে পারে, এমন কোনো খাতে কর বাড়ানো হবে না। কর দিতে গিয়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হবে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশে ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ করা হবে। এজন্য প্রতিটি উপজেলায় কর অফিস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫২ হাজার কোটি টাকা এনবিআর ও কর বহির্ভূত রাজস্ব আয় হিসেবে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে তা ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রতি বছর ১ শতাংশ মানুষকে করের আওতায় আনতে ট্যাক্স জিডিপির অনুপাত ১ শতাংশ হারে বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বর্তমানে দেশের মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। আর সামগ্রিকভাবে ১৪ শতাংশ মানুষ সরকারকে নানাভাবে রাজস্ব দেয়। এ সংখ্যাটি কমপক্ষে ২০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে সরকার। এজন্য আগামী পাঁচ বছরের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এডিপি ২ লাখ কোটি টাকা : আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৫৬৪টি। এর মধ্যে কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৬টি, জেডিসিএফ প্রকল্প ১টি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে ৮৯টি ও বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩৫৮টি। অন্যদিকে, অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত করার জন্য নির্ধারিত প্রকল্প ধরা হয়েছে ৩৫৫টি। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) প্রকল্প ৬২টি। বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্তির সুবিধার্থে বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প ২৪২টি এবং নিজস্ব অর্থায়নে বরাদ্দহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৪৫টি। বরাদ্দসহ অনুমোদিত নতুন প্রকল্প রয়েছে ৪১টি। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায় নতুন অর্থবছরের এডিপির আকার বাড়ছে ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এডিপি ধরা হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এবারের এডিপিতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও শিক্ষা খাতে।

থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণা : আসন্ন বাজেট হবে সংস্কারমুখী। ব্যাংক ও ভ্যাট খাতে থাকছে ব্যাপক সংস্কার। অর্থবছরের শুরুতেই নতুন ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন (২০১২)’ কার্যকরের ঘোষণা থাকছে। সংস্কারের আওতায় থাকবে ব্যাংকসহ পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্র ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতও। তবে জনগণকে রাখা হবে ভ্যাট ও করের চাপমুক্ত। খুব বেশি কর চাপানো হবে না। করপোরেটসহ ক্ষেত্র বিশেষে কর হার কমানো হবে। ঘোষণা থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির। ইতিমধ্যে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু ননএমপিও শিক্ষকের একটি তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এমপিওভুক্তির যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোকে পর্যায়ক্রমে আগামী তিন বছরের মধ্যে এমপিওর আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

ঘাটতি ছাড়াবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা : বিশাল আকারের বাজেটে বাড়বে ঘাটতিও। সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য বরাবরের মতো সরকারকে অভ্যন্তরীণ কিছু উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। এজন্য বাড়ানো হচ্ছে ব্যাংক ঋণের পরিকল্পনা। অন্যদিকে কমিয়ে আনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা। এতে বাজেটে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ সরকারকে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ অপেক্ষাকৃত কম টাকা গুনতে হবে। তবে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়ার আশা করা হচ্ছে প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা।

বাড়বে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা : সুবিধাবঞ্চিত, হরদরিদ্র, বিধবা, অসচ্ছল মানুষ, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় সব ধরনের ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে আগামী বাজেটে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নতুন করে ১৩ লাখ মানুষকে যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৮৯ লাখ মানুষ- যা চলতি বাজেটে ছিল প্রায় ৭৬ লাখ। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আগামী বাজেটে সম্ভাব্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে পত্র-পত্রিকায় যেসব লেখা এসেছে তাতে প্রক্রিয়াটিকে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। এজন্য কমিশন গঠন করে কর কাঠামো সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ও একটা বড় ব্যাপার। দুর্নীতি, অদক্ষতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ- নানা কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন। দিনের পর দিন ভর্তুকি দিচ্ছে। বলা হয় ঋণ আদায় হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এগুলোর মাধ্যমে আয় বৈষম্য কমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আর্থিক খাতের সুশাসনের জন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন। আর বাজেটের সুফল পেতে হলে এসব সংস্কার খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে বাজেটকে আরও জনসম্পৃক্ত করতে কল্যাণমুখী কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর