শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

থমকে গেছে ঐক্যফ্রন্ট

মাহমুদ আজহার

থমকে গেছে ঐক্যফ্রন্ট

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামকাওয়াস্তে দুটি বৈঠক হয়েছে। জোটের বড় দুই শরিক বিএনপি ও গণফোরাম এখন ‘স্লো’ গতিতে চলছে। ফ্রন্ট নিয়ে তারা এখন কিছুই ভাবছে না। এই দুই দলের বিজয়ী এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে গেছেন।

এ নিয়ে নাগরিক ঐক্য, জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ব্যাখ্যা চাইলেও দেওয়া হচ্ছে না। কোনো বৈঠকও ডাকা হচ্ছে না। ক্ষুব্ধ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঐক্যফ্রন্টের অসঙ্গতি দূর করতে এক মাসের আলটিমেটাম দিয়ে ফ্রন্ট ছাড়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। অসঙ্গতি দূর না করা হলে ৮ জুন তিনি ঐক্যফ্রন্ট ছাড়বেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন। এ নিয়ে ফ্রন্টে চরম অস্বস্তি বিরাজ করছে। ‘দুর্বল’ এ ফ্রন্টের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, সংসদে যোগদান প্রশ্নে ব্যাখ্যাসহ নানা অসঙ্গতি নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নাগরিক ঐক্য ও জেএসডি। তারাও বিষয়টি সুরাহা করতে ফ্রন্টের বড় দুই দলকে বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এতে দুই দলই গড়িমসি করছে। আলটিমেটামের আগে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে দেখা করে এর ব্যাখ্যা চান। কেউই এর ব্যাখ্যা দেননি। বরং বঙ্গবীরের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ‘রুঢ়’ ব্যবহার করেন। এ কারণে অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়েই ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছেন কাদের সিদ্দিকী। এ প্রসঙ্গে ফ্রন্টের মূল শরিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি ফ্রন্টে নানা মত থাকতেই পারে। সেটি বৈঠকে বসলে সমাধানও হয়ে যাবে। আমরা শিগগিরই বৈঠকে বসে সবকিছু ঠিক করে নেব।’ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের একাদশ নির্বাচনের পর অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন-পরবর্তী কিছু কিছু কাজে মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তারা সঠিকভাবে চলতে পারেনি। নির্বাচনী সহিংসতায় আহত-নিহতদের পাশে দাঁড়াতে পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল শাহবাগে গণজমায়েত করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। এসব বিষয় আমাদের জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মানুষ এসবের উত্তর জানতে চায়।’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ফ্রন্টের বড় দুই শরিক দল বৈঠকের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সংসদে যোগদান নিয়ে তারা ঐক্যফ্রন্টকে কোনো কিছুই স্পষ্ট করেনি। এ নিয়ে অন্য শরিকদের মধ্যে কিছুটা মান-অভিমান থাকতেই পারে। বৈঠক কবে হবে তাও স্পষ্ট নয়।’ আরও জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্ট থেকে ড. কামাল হোসেনকে মাইনাস করার কথাও ভাবা হচ্ছে। ফ্রন্টের কোনো কোনো নেতা বলছেন, ড. কামাল হোসেন আইনজীবী হিসেবে ভালো হলেও রাজনীতিতে খুবই দুর্বল। তার নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট চলতে পারে না। আমরা যৌথ নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট চালাতে চাই। নইলে ড. কামাল হোসেনকে মাইনাসও করা হবে। এ নিয়ে তিনটি শরিক দলের নেতারা একমত। তবে বিএনপি এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও ভিতরে ভিতরে ড. কামাল হোসেনকে কেউ মানতে পারছেন না। ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটিতে থাকা বিএনপির এক নেতা বলেছেন, আর যাই হোক ড. কামাল হোসেন ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য নন। বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ড. কামাল সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বিএনপিকে আন্দোলনের বাইরে রেখে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছেন। বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের বাইরে রাখাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে নিজেই শক্তি সঞ্চয় করে রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগে একটি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়া সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হননি। সে ঘটনার সূত্র ধরে ওই বৈঠকে বাক-বিত ার পর বিএনপির সিনিয়র দুই নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর দলের স্থায়ী কমিটির আরও দুই সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. মঈন খানকে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য করা হয়। ড. মঈন খান মাঝে-মধ্যে যোগদান করলেও গয়েশ্বর রায় একটি বৈঠকেও অংশ নেননি। এদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ইদানীং পারতপক্ষে ফ্রন্টের বৈঠকে যাচ্ছেন না। এতে জোটের গুরুত্ব কমে গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আদর্শিক ও নীতিগত দিক দিয়েও বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ বলে সম্বোধন করছেন। কিছু দিন আগে এক অনুষ্ঠানে ড. কামালের বক্তৃতার সময় ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন’ এমন কথা বলার দাবি তোলেন বিএনপির উপস্থিত নেতা-কর্মীরা। কিন্তু জিয়াউর রহমানের নাম ড. কামাল আগেও নিতেন না, এখনো নিচ্ছেন না। এতে বিএনপির বড় অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ। বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর মতে, পরস্পরবিরোধী এই রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। আগে রাজনীতি ঠিক করতে হবে। এদিকে ড. কামালও বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ। ধানের শীষ প্রতীকে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন। জামায়াত নেতাদের হাতেও ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়া হয়। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ হন ড. কামাল হোসেন। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, আগে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টেই থাকতেন না। ড. কামাল হোসেনের কিছু সিদ্ধান্তে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে জঘন্য নাটক হয়েছে, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন নাটকের নজির নেই। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পরও গণফোরামের সুলতান মনসুর শপথ নিলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। মোকাব্বির খান শপথ নিলে ড. কামাল হোসেন তাকে ‘গেট আউট’ বলেন। পরে দেখা যায় গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিলে মোকাব্বির খান উপস্থিত। এসব নিয়ে মানুষের মধ্য বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মানুষ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আমরা জবাব দিতে পারি না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর