রবিবার, ৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
‘আমি সিরাজুল আলম খান-৪’

তখন ভোর ৪টা, বঙ্গবন্ধুর চোখ লাল তামাকের পাইপ কামড়ে ধরেছেন

পীর হাবিবুর রহমান

তখন ভোর ৪টা, বঙ্গবন্ধুর চোখ লাল তামাকের পাইপ কামড়ে ধরেছেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

রাজনীতির রহস্যপুরুষ ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান বেতারের মাধ্যমে ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে দেয়। তখন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল। বাইরে বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে নগরী। চারদিক থেকে বানের মতো মিছিল এসে শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সেখান থেকে ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ সভার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল অবিলম্বে সংসদ অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। সেদিনই জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে মাস্টারদা সূর্যসেন হল রাখা হয়। ছোট পরিসরে নিউক্লিয়াসের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ২ মার্চের সভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হবে। ডাকসু ভিপি রবকে ডেকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। এটি শোনার পর রবকে খুব উত্তেজিত দেখলাম। সে উত্তেজনা শুধু একটি পতাকা উত্তোলনের আবেগ থেকে নয়, তারচেয়ে বড় কিছু করার প্রত্যয় যেন তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। যথারীতি ২ মার্চ কলাভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদ থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখনের উপস্থিতিতে আ স ম রব পতাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায়। ২ মার্চের সেই সমাবেশ থেকে ৩ মার্চ পল্টনে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

সিরাজুল আলম খানের জবানবন্দিতে লেখা ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বইয়ে তিনি আরও বলেছেন, এর আগে ১ মার্চ রাতেই নিউক্লিয়াসের পক্ষ থেকে আমরা পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি আর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে পরিচালনা করার প্রয়োজন নেই বলে সিদ্ধান্তে আসি। কারণ আমাদের মনে হলো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিয়ে অগ্রসর হতে গেলে ভবিষ্যতে ছাত্রলীগ ও ডাকসু ছাড়া অন্যদের তরফ থেকে বাধা আসতে পারে। এ চিন্তা থেকে আমরা ডাকসু ও ছাত্রলীগ দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নিউক্লিয়াসে তা অনুমোদিত হয়। এভাবেই ২ মার্চের পতাকা উত্তোলনের মতো ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাটি ঘটানো সম্ভব হয়। সেদিন সন্ধ্যা হতেই আমরা নিউক্লিয়াস থেকে ৩ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিই। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠের প্রায় শেষ পর্যায়ে হঠাৎ দেখলাম মুজিব ভাই ১৫/২০ জনকে নিয়ে পল্টনের মঞ্চের দিকে আসছেন। তার আসার এ খবরটা আমার জানা ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ইশতেহার পাঠ বন্ধ হয়ে গেল। মুজিব ভাই মঞ্চে উঠলেন, তার সামনেই ঘোষিত হলো ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম হলো’। ঘোষণার মধ্যে আরও ছিল জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং সামনের দিনের সশস্ত্র সংগ্রামের ইঙ্গিত ও নির্দেশনা। সিরাজুল আলম খানের ভাষায় বঙ্গবন্ধু সেদিন ৫ মিনিটের মতো বক্তব্য রাখলেন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দিলেন। সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ‘তিনি আজও জানেন না কী কারণে সেদিন বঙ্গবন্ধু অপ্রত্যাশিতভাবে পল্টনের জনসভায় হাজির হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনে অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চের ১৫ তারিখ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসতে। একপর্যায়ে ভুট্টোও এলেন। ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হলো। সিরাজুল আলম খান আরও বলেছেন, বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে তা জানানোর জন্য প্রতিদিন রাত ১০টার পর তার ধানমন্ডির বাসভবনে তাকে যেতে বলতেন। সবাই চলে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে বসতেন। প্রথম দিন আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘সিরাজ আলোচনা তো এক দিনে শেষ হবে না। এটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলবে’। আমি আমার সে সময়ের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে বললাম, মুজিব ভাই, আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যটি যেন কোনোভাবেই ইয়াহিয়া বুঝতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন’। তিনি বললেন ঠিকই বলেছিস।

সিরাজুল আলম খান আরও বলেছেন, ইয়াহিয়া বা ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার আগে মুজিব ভাই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে তার বাসায় আসতে বলতেন। আমাকেও যেতে বলতেন। তিনিসহ আওয়ামী লীগাররা যেন মুজিব কোট পরে আলোচনায় যান সেটি নিশ্চিত করতে আমি বলতাম। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ছাড়া সবাই মুজিব কোট পরতেন। তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি মুজিব ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। সংবাদপত্র ও বিদেশি গণমাধ্যমগুলো আলোচনা অগ্রগতি হচ্ছে বলে সংবাদ দিত। আওয়ামী লীগ ও তাজউদ্দীন আহমেদের লেখা প্রেসনোটে আলোচনার বিষয়বস্তু জানাত। ২১ মার্চ মুজিব ভাই বৈঠক থেকে ফিরে জানালেন নামমাত্র এক পাকিস্তান রেখে দুই অংশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রী এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে আলোচনা শেষ হয়েছে। ২২ মার্চ সংবাদপত্রগুলো লিখল আলোচনা সফল। সে রাতে মুজিব ভাইকে খুব গম্ভীর ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলাম। পরের দিন ২৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরোধ দিবস। ওইদিন মুজিব ভাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যান। নিউক্লিয়াস থেকে আমরা ঠিক করলাম, মুজিব ভাইর গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। মুজিব ভাই আপত্তি জানালেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চাপে গাড়িতে পতাকা লাগাতে রাজি হন। যাওয়ার আগে কামরুল আলম খসরু রাইফেলের ফাঁকা আওয়াজে তাকে অভিবাদন জানায়। আমাদের দিক থেকে যা ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের ইঙ্গিত। হাসানুল হক ইনু মুজিব ভাইয়ের গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে দেয়।

২৩ মার্চ রাত ৮টার দিকে মুজিব ভাইয়ের বাড়ি থেকে প্রায় সবাই চলে গেলে আমি রাত ১০টায় ৩২ নম্বরে উপস্থিত হই। রাজ্জাক এসে বলল, ‘সিরাজ ভাই, কী করবেন? আমি তার দিকে তাকাতেই পেছনে দেখলাম শেখ মণি, তোফায়েল, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ ও শেখ শহীদ। আমি ও রাজ্জাক দুজনেই দুজনকে বললাম, আমাদের বসতে হয়। তখন নিউক্লিয়াসের আলাদাভাবে বসার সময় সেই। বসার জন্য সেখান থেকে আমরা সবাই আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ খুলনার মোহসীন ভাইয়ের লালমাটিয়ার বাসায় গেলাম। যাওয়ার আগে মুজিব ভাইকে চিন্তিত দেখলাম। জানতে চাইলেন, কোনো কথা আছে কিনা। বললাম রাতে দেখা করব। তিনি রাত ২টার পরে যেতে বললেন। আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করলাম মোহসীন ভাইয়ের বাসায়। প্রথমে আমি বৈঠকের ফলাফল জানালে সবাই বলল সে তো আমরাও জানি। এখন মুজিব ভাইকে কীভাবে রাজি করানো যায়? দুই প্রধানমন্ত্রীর ফর্মুলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি বললাম, আমরা সবাই একমত থাকলে মুজিব ভাই রাজি হবেন। রাত ঠিক আড়াইটায় মুজিব ভাইয়ের বাসার দোতলায় আমি, শেখ মণি, রাজ্জাক, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ ও শেখ শহীদ মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে বসলাম। সেখানে আরও ছিলেন বেগম মুজিব ও মমিনুল হক খোকা মামা। মুজিব ভাই কথা তুললেন। কীভাবে কী করতে হবে বল? আমরা বললাম এ চুক্তি বাংলার মানুষ কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। আর এবার না হলে কোনো দিনই বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার পক্ষে আনা যাবে না। তিনি বললেন, ‘আমিও তাই মনে করি। কিন্তু কী বলে আলোচনা ভাঙতে হবে? আমার দিকে তাকিয়ে বললেন সিরাজ তুই কি বলিস? তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন যা বলার কাল সকালেই বলতে হবে। ইয়াহিয়া কাল চলে যাবে।’ আমরা সবাই কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। তারপর আমি বললাম একটাই সমাধান, আলোচনা ভেঙে দিতে হবে। প্রথমে তিনি কোনটা? পরক্ষণেই ও হ্যাঁ বুঝেছি’। তখন ভোর ৪টা। বঙ্গবন্ধুর চোখ লাল। তামাকের পাইপ কামড়ে ধরেছেন। এটি তিনি সাধারণত কঠিন সময়েই করতেন। পরে বললেন, ‘তোরা যা। একটা উপায় বের করতে হবে’। আমরা বেরিয়ে আসার সময় আমাকে বললেন, ‘তুই পাঁচ মিনিট পরে যা।’ অন্য সবাই নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, দুই মুদ্রা ব্যবস্থা চুক্তি মধ্যে থাকতে হবে। মুজিব ভাই বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি’। আমি এরপর এক লাখ মিলিশিয়ার কথা যোগ করলাম। তিনি বললেন, ‘মিলিশিয়ার ব্যাপারে আমি তাদের আগেই বলেছি। এখন দুই মুদ্রার বিষয়টাই আলোচনা ভাঙার একমাত্র উপায়’। তিনি আমাকে পরদিন সকাল ১০টার দিকে যেতে বললেন। বললাম, দরকার নেই। আপনি আলোচনা থেকে ফিরে এলেই আসব। আমি দুপুরে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, আগামীকাল রাতেই ওরা আক্রমণ করবে। প্রথম পর্যায়েই প্রতিরোধটা যেন শক্ত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।’ আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কাউকে বলিস না, আমি বাসাতেই থাকব। আমাকে না পেলে ওরা উন্মাদের মতো আচরণ করবে আর সে সুযোগে আমাকেও মেরে ফেলবে। এটি স্বাধীনতার আগে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে পুলিশের মাধ্যমে যে বার্তা দিয়েছিলেন তা হলো, শত্রুরা আমাদের আঘাত করেছে। আপনারা পাল্টা আঘাত করুন। ইনশা আল্লাহ বিজয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা। মুজিবুর রহমান। এ বার্তার ব্যাপারে মুজিব ভাই আমার সঙ্গে আগে আলাপ করেছিলেন এবং এর দু-তিনটা খসড়াও তৈরি করেছিলেন। ড. কামাল হোসেন এটির মুসাবিদা করে দেন। তাজউদ্দীন ভাই ও আমাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, এটি মুজিব ভাইয়ের কাছে নিয়ে যান।

সিরাজুল আলম খান বলেছেন, তিনি ২৫ মার্চ ভোর রাত ৫টা পর্যন্ত লালবাগ থানার ওসির রুমে কাটিয়েছেন। সেখানে এই বার্তা নিজে শুনেছেন। ২৬ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ২৭ মার্চ পর্যন্ত কেরানীগঞ্জে মোস্তফা মুহসিন মন্টুর বাড়িতে ছিলেন। ২৭ মার্চ রাতে রতন গগনদের বাড়িতে তিনি, শেখ মণি, রাজ্জাক, আরেফ, তোফায়েল, রব, সিরাজ, খসরু ও ক্যাপ্টেন বেগ জড়ো হয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডা. আবু হেনা, শেখ মণি, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান কলকাতা চলে গেলেন। তিনি, রাজ্জাক, খসরু, সুমন মাহমুদ বাবুল, ক্যাপ্টেন বেগ একসঙ্গে খুলনা পর্যন্ত গেলেন। সেখান থেকে দুই ভাগ হয়ে আবদুর রাজ্জাক ও খসরু সাতক্ষীরা দিয়ে কলকাতা গেলেন। তিনি প্রথমে পটুয়াখালী গেলেন। সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে দেখা হলো। নাজমুল হক নামে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও তাদের সঙ্গে ছিলেন। কাজী আরেফ ঢাকার দায়িত্বে থাকলেন। বলা হলো, যতদিন সম্ভব তিনি এখানে থেকে বিএলএফ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এরপর তিনি, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নূরুল ইসলাম ও নাজমুল হক চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও তৌফিক-ই-এলাহির সাক্ষাৎ পেলেন। তারা বললেন, তাকে নিরাপদে কলকাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করার বার্তা এসেছে। তিনি নূরুল ইসলামসহ গেদে বর্ডার দিয়ে পশ্চিমবাংলায় ঢুকে ৩১ মার্চ কলকাতা পৌঁছলেন। সেখানে আবদুল মালেক উকিল তাকে চিত্তরঞ্জন সুতারের বাড়িতে নিয়ে গেলে সেখানে শেখ মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েলকে পেলেন। এরপর প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। সিরাজুল আলম খানের ভাষায়, তাদের উদ্যোগে নেতাদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সরকার গঠনের কাজ চূড়ান্ত করা হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ নিয়ে তাদের চারজনকে অর্থাৎ শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি মেজর জেনারেল সুজন সিং উবানের সহায়তায় তারা সংগঠিত হতে শুরু করেন। দেরাদুনের টান্ডাওয়া ও আসামের হাফলংয়ের বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হয়। এভাবে ৭ হাজার বিএলএফ সদস্য ট্রেনিং শেষে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ও অন্যসব মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে মিলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ডিসেম্বরের ৪ তারিখ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র ১১ দিনের মাথায় ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধ শেষ হয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্সে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ থেকে ১০ জানুয়ারি ’৭২ পর্যন্ত সারা দেশে থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নিজস্ব প্রশাসন চালু রাখে। বস্তুত ওই ২৪/২৫ দিনই প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে দেশ পরিচালিত হয়েছিল। এর আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আর কখনই তা হয়নি। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ’৭২ দেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীনকে দেওয়া হয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ১৫ দফা সুপারিশ দেন। ’৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক সময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু তাদের চারজনকে অর্থাৎ শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে দেশ পরিচালনার বিষয়ে একটি সুপারিশমালা দিতে বললে তিনি সেটি দেন।

উল্লেখ্য, সিরাজুল আলম খানের বইয়ে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে প্রতিদিন পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ একমত যেমন হচ্ছেন তেমনি অনেকে দ্বিমত পোষণ করছেন। গতকালও মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান তোফায়েল আহমেদ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুকে লিডার বলে সম্বোধন করতেন। তিনি তার বইয়ে অনেক কিছুই মনগড়া কল্পনাপ্রসূত ও আমিত্বের ওপর লিখে গেছেন, যার সত্যতা নেই। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডে জেলখানায় নিহত কামারুজ্জামানও ছিলেন। আর ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন তাদের চারজনকে অর্থাৎ শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে নিয়মিত ব্রিফ করতেন। তাদের যেমন নির্দেশনা দিতেন তেমনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকেও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে এসে বলতেন, ইয়াহিয়া খান সময় ক্ষেপণ করছে। কোনো ফলাফল আসবে না। আমিও সময় নিচ্ছি প্রস্তুতির। তোরা প্রস্তুতি চালিয়ে যা। তোফায়েল আহমেদ তথ্য-উপাত্তসহ শিগগির তার বক্তব্য দেবেন। ...চলবে

সর্বশেষ খবর