মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘুষকাণ্ডে দুদক পরিচালক বরখাস্ত

ডিআইজি মিজান বললেন, আমাকে ফাঁসাতেই এ কাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘুষকাণ্ডে দুদক পরিচালক বরখাস্ত

অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) অনুসন্ধানের মুখে থাকা পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছে তদন্তের তথ্য ফাঁস, চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ডিআইজি মিজান ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে নতুন করে অনুসন্ধান করা হবে। আগে যতটুকু অনুসন্ধান হয়েছে, তার ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে নতুন যিনি দায়িত্ব পাবেন তিনি অনুসন্ধান শেষ করবেন। গতকাল কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান। তবে নিজেকে বাঁচাতে এবং দুদক পরিচালক বাসিরকে ফাঁসাতে এমন কাজটি করেছেন বলে দাবি করেছেন ডিআইজি মিজান। যদিও দুদক পরিচালক এনামুল বাসির বলছেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে আমার কণ্ঠ জুড়ে দিয়েছেন ডিআইজি মিজান।’

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনুসন্ধানের তথ্য অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করায় চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে পরিচালক এনামুল বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মিজান ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের একজন পরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’ তবে মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের প্রতিবেদন এনামুল বাসির কমিশনে জমা দেননি বলে দুদক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে ডিআইজি মিজানকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। গত বছরের ৩ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। প্রথমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী, পরে এই দায়িত্ব পান বাসির। ডিআইজি মিজান গত রবিবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দাবি করেন, দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাসির অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন এবং বিভিন্ন সময় তার কাছে তদন্তের তথ্য সরবরাহ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দুদক পরিচালক বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এনামুল বাসির কমিশনের তদন্ত কমিটির কাছে বলেছেন, তিনি ঘুষ নেননি। এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, এনামুল বাসিরের সঙ্গে ডিআইজি মিজানুর রহমানের কথোপকথন নিশ্চিত হতে অডিও রেকর্ড ফরেনসিক পরীক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া মিজানের ঘুষ প্রদানের বিষয়টি প্রমাণিত হলে দুদক মামলা করবে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এনামুল বাসিরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা অসদাচরণের। এতে দুদক বিব্রত নয়। ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠানের নয়। দুদকের ৮৭৪ জন কর্মীর সততার নিশ্চয়তা কমিশন দিতে পারে না। কিন্তু কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা হবে। এদিকে টেলিভিশনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, খন্দকার এনামুল বাসিরকে গত জানুয়ারিতে প্রথমে ২৫ লাখ ও পরে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন মিজানুর। কিন্তু ২ জুন মিজানুরকে বাসির জানান, তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তবে দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারের চাপে তাকে অব্যাহতি দিতে পারেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিজানুর অর্থ লেনদেনের সব কথা ফাঁস করে দেন। এ বিষয়ে প্রমাণস্বরূপ এনামুল বাসিরের সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক অডিও রেকর্ড হাজির করেন। তবে দুদক পরিচালক এনামুল বাসির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডিআইজি মিজানের দেওয়া অডিও রেকর্ডে কয়েকটি বাক্য ছাড়া বাকি কথাগুলো আমার নয়। তিনি প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে অন্য কথাগুলো আমার বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। আবার তিনি নাকি দাবি করেছেন, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি তার গাড়িচালক হৃদয়ের নামে ওঠানো একটি সিম এবং সেলফোন আমাকে দিয়েছিলেন। ওই ফোনেই নাকি তিনি আমার সঙ্গে কথা এবং মেসেজ আদান-প্রদান করতেন। তদন্ত কর্তৃপক্ষ তো চাইলেই এর সত্যতা যাচাই করতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডিআইজি মিজান মনগড়া কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন। তার ভাই ও ভাগ্নের নামে সম্পত্তির খোঁজ নেওয়া শুরু করলে আগের তদন্ত কর্মকর্তা ফরিদ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ওই কর্মকর্তাকে দুদক থেকেই সরিয়ে দেন। ফরিদ পাটোয়ারী বর্তমানে নদী রক্ষা কমিশনে কর্মরত।’ তবে ডিআইজি মিজান বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেছেন, টানা ছয় মাস ধরে তদন্ত করেও চার্জশিট না দিয়ে টাকা দাবি করে আসছিলেন বাসির। নিজেকে বাঁচাতে এবং এনামুল বাসিরকে ফাঁসাতে তিনি অডিও রেকর্ড করেছেন। যোগাযোগের জন্য তিনি তার গাড়িচালক হৃদয়ের নামে ওঠানো একটি সিম ও একটি সেলফোন দিয়েছিলেন এনামুল বাসিরকে। দুদকসূত্র বলছেন, অনুসন্ধানে এরই মধ্যে ১৯৯০ সালে জন্ম নেওয়া ডিআইজি মিজানের ভাগ্নে মাসুদুল হাসানের নামে ১ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। ২০০৩ সালে মাসুদুল হাসানের ১৩ বছর বয়সেই তার নামে ১ কোটি টাকার ট্যাক্সের ফাইল খোলা হয়। পরে তার নামে ৬৬ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট ৬৩/১ কাকরাইল দ্বিতীয় তলায়। ওই ফ্ল্যাটে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বাকি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। ডিআইজি মিজানের ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান পেশায় বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে একটি ছোট্ট ফার্মেসির মালিক। তবে তার নামে বেইলি রোডের বেইলি রিজ নামের বহুতল ভবনের চার তলায় ২ হাজার স্কয়ার ফুটের ৫৯ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ওই ফ্ল্যাটেই কথিত স্ত্রী মরিয়ম আক্তার ইকো বসবাস করতেন। তবে ৪০ লাখ টাকা সরাসরি মাহবুবুর রহমান তার বড় ভাই মিজানকে দান করেছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। স্ত্রী সোহেলীয়া আনার রত্নার নামে পুলিশ প্লাজা কনকর্ডের ৩১৪ নম্বর দোকান ‘লেডিস মার্ট’-এ ৭০-৮০ লাখ টাকার মালামাল আছে দাবি করলেও ২০-২৫ লাখ টাকার মালামালের বেশি পাওয়া যায়নি। স্ত্রী রত্না তার মায়ের কাছ থেকে নগদ ৭৩ লাখ টাকা পেয়েছিলেন এবং ওই টাকা দিয়ে উত্তরার ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর