শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
তোফায়েল আহমেদ বলছি-৩

সিরাজ কি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের খবর জেনেই ভারত গিয়েছিলেন?

পীর হাবিবুর রহমান

সিরাজ কি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের খবর জেনেই ভারত গিয়েছিলেন?

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তখনকার ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহসান্নিধ্য পাওয়া তোফায়েল আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন, সিরাজুল আলম খান কি তাহলে জানতেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে? যে কারণে তিনি নিজেই বলেছেন, ১ বা ২ আগস্ট তিনি ভারতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন সেই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের এক মাস আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে ভারতে চলে যেতে বলেন এবং সেই সাক্ষাৎকালে দেশে সামরিক শাসনের গুঞ্জনের কথা তুলতেই নাকি বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তিনি জানেন, এটা তাঁর বিরুদ্ধে নয়! তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে। কী নির্মম রসিকতা! কী ভয়াবহ মিথ্যাচার করলেন সিরাজুল আলম খান। রুচিতে আর ধরে না তার ইতিহাস বিকৃতি ও নির্লজ্জ মিথ্যা তত্ত্বের জবাব দিতে। তোফায়েল বলেন, প্রথমত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের তখন কোনো দেখাই হয়নি। তাই তাঁকে ভারত চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সিরাজুল আলম খানের রাজনীতিটাই রহস্য, ষড়যন্ত্র আর অন্ধকারে মোড়া বলেই তিনি তখন ভারত চলে গিয়েছিলেন। কেন ভারত গেলেন তার যৌক্তিক কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেননি। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবর জেনেই কি তিনি ভারত চলে গিয়েছিলেন?

তোফায়েল আহমেদ জানান, তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্যই তিনি জানতেন। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়নি। তাঁকে ভারত যেতে বলাও হয়নি এবং তিনিও সামরিক শাসনের গুঞ্জনের কথা বলেননি। তখন তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের মন্ত্রীও নন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি। সামরিক অভ্যুত্থান হলে তাঁর বিরুদ্ধেই হওয়ার কথা। তাই সিরাজুল আলম খান যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বলতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। অথচ তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকান্ডের ১৩-১৪ দিন আগে এভাবে গোপনে ভারত চলে যাওয়ার রহস্য তিনিই বলতে পারবেন। বলতে পারবেন জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কেন এমন আজগুবি অসত্য অবিশ্বাস্য বক্তব্য দিলেন। কী ষড়যন্ত্র ও রহস্য লুকিয়ে এর নেপথ্যে?

তোফায়েল আহমেদ বলেন, তিনি দুঃখিত ও ব্যথিত যে, একদিন স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে যে সিরাজুল আলম খানকে শ্রদ্ধা করতেন, আজ বিবেকের তাড়নায় তার কর্মকা- ও ইতিহাস বিকৃতির কারণে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, তার কর্মকা- বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, তিনি কতটা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে কী ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। একটি সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে দ্রুত পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্যোদ্দীপ্ত প্রতিভাবান তরুণদের বিভ্রান্ত করে ছাত্রলীগে ভাঙন এনে জাসদ সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত এনেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা, বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট, সন্ত্রাসের পথ ধরে সরকারকে ব্যস্ত রাখার, অস্থির, অশান্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা গোপন রাজনীতির সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অগ্রনায়ক সিরাজ সিকদারের সঙ্গে তার গভীর যোগাযোগ ছিল। জনপ্রতিনিধিদের একের পর এক হত্যা, পাটের গুদামে আগুন, থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েই তারা বসে থাকেননি, তিনি একদিকে বলছেন জাসদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তার নীতিগত অবস্থান ছিল, দলটি হবে আওয়ামী লীগবিরোধী। বঙ্গবন্ধুবিরোধী নয়। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন মুক্ত গোটা জাতি অধীর আগ্রহ নিয়ে গভীর অপেক্ষায় কখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসবেন জাতির পিতা শেখ মুজিব তখন সিরাজুল আলম খান সেই মহান নেতার দেশে ফেরার আগেই ১ জানুয়ারি ’৭২ সাল থেকে গণকণ্ঠ প্রকাশ শুরু করলেন; যা পরে তার জাসদের মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু ও সরকারবিরোধী অপপ্রচারে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তাহলে কি তিনি যুদ্ধের সময় থেকেই ষড়যন্ত্রের নীলনকশা শুরু করেছিলেন? তিনি তার জাসদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে অপপ্রচার ও অগণতান্ত্রিক কর্মকা- চালিয়ে দেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করেছিলেন। এমনকি বলেছেন, সেই সময়ের জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ, যেটি অসত্য সংবাদ ও গুজব ছড়াতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে সেই পত্রিকার অফিসে বসে কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছিলেন তা পরে গভীর হয়েছিল। কর্নেল তাহের বীরউত্তম তখন সেনাবাহিনীর নিয়মিত অফিসার থাকা অবস্থায় গোপনে তাকে জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির পদে অঘোষিতভাবে রাখা হয়েছিল। এমনকি তিনি আরও বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের পথে ব্যর্থ হয়ে তারা সেনাঅভ্যুত্থানে অগ্রসর হন। আর মেজর জলিলের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রতিটি ইউনিটে ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে তোলা হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল হৃদয়ের উদারতার সুযোগে কতটা রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধানবিরোধী, বেআইনি কর্মকান্ডের নেপথ্য কুশীলব হয়ে উঠেছিলেন, সেই নির্মম সত্য তার লেখায় চলে এসেছে। এ কারণেই তিনি আগাগোড়াই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে বিতর্কিত হয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ঢাকাসহ তার আশপাশে ৪০টি ঘাঁটি তারা তৈরি করেছিলেন এবং ’৭৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সে বছরের ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা চালিয়েছিলেন। কোনো মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের রাজনৈতিক কর্মসূচি স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে-পরে কখনো হয়নি। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের মাধ্যমে যে বিপ্লবী গণবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তারা শুধু থানা আক্রমণই করেনি, বিত্তশালীদের কাছ থেকে জবরদস্তিমূলক অর্থ আদায়ও করেছে। এমনকি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা হামলা, বায়তুল মোকাররমে সাইকেল বোমা, কয়েকটি বাসে যাত্রী নামিয়ে অগ্নিসংযোগ, গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট সন্দেহ করে জিয়াউল আবেদীনকে হত্যা করা; এমনকি ভারতীয় হাইকমিশনারের ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনাও ঘটানো হয়। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাসদের সমাজবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী বেআইনি কর্মকা- অন্যদিকে তার রহস্যজনক ভূমিকা শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে একের পর এক আঘাত করে অস্থির, অশান্ত করেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন রাজনৈতিক দল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি আর জাসদের কর্মকান্ডের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। বরং তিনি সিরাজ সিকদারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে যে আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন, তা থেকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতে সিরাজ সিকদারের সঙ্গে সমন্বয় করেই তিনি সব অপকর্ম চালিয়েছেন। তিনি না ছিলেন বিপ্লবী, না ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদ। উগ্র, হঠকারী, অসাংবিধানিক, বেআইনি সশস্ত্র ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পথটাই তিনি তার জীবনে ধারণ ও লালন করেছিলেন। আর জাসদ গঠনের মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তির উগ্র, হঠকারী পথে টেনে নিয়ে অনেক প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক কর্মীর সম্ভাবনাকে আঁতুড়ঘরেই শেষ করে দেননি, সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিকেই অভিশপ্ত করেননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরির অভিযোগেও অভিযুক্ত হন। ইতিহাসের নির্মম দায় যেখানে তিনি এড়াতে পারেন না সেখানে আজ নতুন করে সব ব্যর্থতার পথহাঁটা গ্লানি ও পরাজয় নিয়ে এখন ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে নিজের মিথ্যা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিটি মিথ্যাচারের ওপর ভর করে শুরু করেছেন। কিন্তু ইতিহাসে মিথ্যা ও খলনায়কের জায়গা নেই।

তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, অগ্নিঝরা উত্তাল একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ও নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি যখন এক মোহনায় মিলিত এবং তাঁর আদেশ-নির্দেশ প্রতিটি জনতা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে, তখন ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রায় রাতে তাঁর সঙ্গে একান্তে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ বলে সিরাজ যে দাবি করেছেন, তা সিরাজুল আলম খানের সত্যের অপলাপ ছাড়া, নির্জলা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় চার নেতার সঙ্গে আলোচনা করতেন। আর মুজিববাহিনীর আমাদের চার প্রধানকে নিয়মিত বলতেন, ইয়াহিয়া খান সময় ক্ষেপণ করছেন। আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। ইয়াহিয়া খান যেমন সময় নিচ্ছেন, তেমনি আমিও স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য আমার মতো করে সময় নিচ্ছি। তোমরা তোমাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাও। চলবে...

সর্বশেষ খবর