শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজস্ব আয় বাড়ানোই চ্যালেঞ্জ

লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেই টার্গেট পূরণ করতে গেলে জনগণের কাছ থেকে নতুন করে ৬৮ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি কর আদায় করতে হবে। ১ জুলাই শুরু হচ্ছে নতুন করবর্ষ। আর তখন থেকেই এই করের বোঝা চাপবে জনগণের ওপর। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সর্বমোট ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকার মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথমবারের মতো নিজের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো আমরা কোনোভাবেই কোনো করদাতার ওপর বোঝা হিসেবে কর চাপিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে।’ তিনি কর আদায়ে ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের একটি উক্তি অনুসরণ করার কথা বলেছেন। উক্তিটি হচ্ছে, ‘রাজহাঁস থেকে পালক ওঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়।’

অর্থাৎ তিনি কর আদায় বাড়াবেন, কিন্তু জনগণকে কষ্ট বুঝতে দেবেন না। কীভাবে তা সম্ভব! বিশ্লেষকরা বলছেন, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল বাজেটে এটিই হয়। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ে। চাল, ডাল, লবণ, তেল যা কিছু কেনা হবে; নাচ, গান, সিনেমা, নাটক যা কিছু দেখা হবে; মুড়ি, মুড়কি, চিনি, চানাচুর যা কিছু খাওয়া হবে তার সবকিছু থেকেই এ কর কেটে নেওয়া হবে। আর এটি হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর যা ভ্যাট নামে পরিচিত। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন এ ভ্যাট আইনের জাল ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট ধরা হয়েছে তার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ উৎসের মধ্যে রয়েছে আয়কর, ভ্যাট, আমদানি ও রপ্তানি কর এবং আবগারি শুল্ক। এসব খাত থেকেই মূলত এনবিআরকে সোয়া ৩ লাখ টাকা আয় করতে হবে সরকারকে। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এ লক্ষ্য ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে (নয় মাসে) রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। টার্গেট পূরণ করতে হলে আরও প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা শেষ তিন মাসে আদায় করতে হবে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এর চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট পূরণ। সংশ্লিষ্টদের মতে গত পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট বাড়াতে বাড়াতে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে সে তুলনায় সংস্থাটির জনবল বাড়েনি। বাড়েনি দক্ষতাও। সেই পুরনো কাঠামো আর একই জনবলদ্বারা দ্বিগুণ রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে এনবিআর কর্মকর্তাদের। অর্থমন্ত্রী অবশ্য প্রস্তাবিত বাজেটে কর আদায়ে বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলেছেন। এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগের কথা বলেছেন তিনি। অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করার কথাও বলেছেন। এ ছাড়া বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থাপনা শতভাগ অটোমেশনে আনা, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মালামাল খালাস বন্ধ করা, আমদানির বিপরীতে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে বিশেষায়িত ইউনিট খোলা এবং আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরীক্ষা করতে স্ক্যানার বসানোর কথাও বলেছেন। রাজস্ব বাড়াতে এসব সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় আয়কর অফিস স্থাপন, মাঠপর্যায়ে কর অঞ্চলের সংখ্যা ৩১ থেকে বাড়িয়ে ৬৩টিতে উন্নীতকরণ, কর তথ্য ইউনিট, উৎসে কর ব্যবস্থাপনা ইউনিট ও আয়কর বিরোধ ব্যবস্থাপনা সেল স্থাপনের কথা বলেছেন। আগামী কয়েক বছরে নতুন করদাতার সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্যও ঘোষণা করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংস্কারের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। তা না থাকলে রাজস্বের যে টার্গেট তা অর্জন করা যাবে না।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের যে নতুন টার্গেট দেওয়া হয়েছে তা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যে প্রকৃত রাজস্ব আদায় হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এত বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য বাজেটে যে ধরনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তা ভালো। তবে এসব সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগবে। সেজন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে দেখতে হবে আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে কিনা। এখন যে অর্থনৈতিক চিত্র দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো নয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নতুন বিনিয়োগে ঋণ দেওয়া যাবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মচাঞ্চল্য হবে না। আর বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান না হলে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায়ও বাধাগ্রস্ত হবে। তখন এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

সর্বশেষ খবর