শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা শিল্প ও আবাসনে

রুহুল আমিন রাসেল

এবার সহজেই আবাসন খাতের জমি, ফ্ল্যাট, হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করা হলে, এই অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না আয়কর বিভাগ। তবে এই করহারও অত্যধিক হওয়ায় বিনিয়োগ করা অপ্রদর্শিত অর্থের ওপর করহার কমানো হয়েছে। ফলে করদাতারা অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ অতি দ্রুত আয়কর নথিতে প্রদর্শন করবেন। প্রস্তাবিত বাজেটের এই সুবিধা পেয়ে দেশের আবাসনশিল্প খাত চাঙ্গা হবে বলে মনে করেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, আগে যেখানে রাজধানীর গুলশান-বনানীর মতো জায়গায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে গেলে ১০ শতাংশ হিসেবে ৩ লাখ টাকা বাড়তি কর দিতে হতো, সেখানে প্রস্তাবিত বাজেটে দিতে হবে ৮২ হাজার টাকা। শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৈধভাবে অর্জিত টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ হিসেবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন ও শিল্পখাতে এই অর্থ বিনিয়োগের সহজ সুবিধা প্রদান করার সিদ্ধান্তটি সঠিক। অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে বৈধভাবে উপার্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসনখাতে বিনিয়োগের সুযোগ এবং ফ্ল্যাট-প্লট নিবন্ধন ফি ও কর কমানোর দাবি দীর্ঘদিন যাবত জানিয়ে আসছিল আবাসনখাতের সংগঠন রিহ্যাব। শিল্পে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগের দাবি দীর্ঘদিন যাবত করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতদিন পর ব্যবসায়ীদের সে দাবি পূরণ হলো। আবাসনখাত, হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে গতকাল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০১৯- ২০২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি বলেন, দেশের নাগরিকরা সরকারকে রাজস্ব প্রদানে আগ্রহী, কিন্তু নানাবিধ কারণে আমরা সেই রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হচ্ছি। আমি আশা করছি, এ হ্রাসকৃত করহারের সুযোগ নিয়ে করদাতারা ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় এবং দালান নির্মাণে তাদের অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ অতি দ্রুত আয়কর নথিতে প্রদর্শন করবেন এবং স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিতভাবে করের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই বাজেটে বলা হয়, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে পণ্য বা সেবা উৎপাদনজনিত উদ্ভূত আয়কে দশ বছরের জন্য বিভিন্ন হারে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনে অপ্রদর্শিত আয় থেকে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করা হলে, ওই বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস সম্পর্কে আয়কর বিভাগ থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না- এ সংক্রান্ত একটি বিধান আয়কর অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করছি। বিদ্যমান আইনে নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করা হলে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় এবং দালান নির্মাণে বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস সম্পর্কে আয়কর বিভাগ থেকে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না। তবে এই হারটি অত্যধিক হওয়ায় করদাতারা খুব একটা সাড়া দিচ্ছেন না। ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় এবং দালান নির্মাণে বিনিয়োগ স্বপ্রণোদিতভাবে আয়কর নথিতে প্রদর্শনে করদাতাদের আরও আগ্রহী করার জণ্য এ সংক্রান্ত বিদ্যমান করহার কমানোর প্রস্তাব করছি। আমি আশা করছি- এ হ্রাসকৃত করহারের সুযোগ নিয়ে করদাতারা ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় এবং দালান নির্মাণে তাদের অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ অতি দ্রুত আয়কর নথিতে প্রদর্শন করবেন এবং স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিতভাবে করের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুযায়ী- রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় ২০০ বর্গমিটারের (১ বর্গমিটার = ৯ বর্গফুট) কম আয়তনের ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক ভবন কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৪ হাজার টাকা কর দিতে হবে। ২০০ বর্গমিটারের বেশি হলে দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া জমি কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ১৫ হাজার টাকা। একইভাবে ধানমন্ডি, ডিওএইচএস, মহাখালী, লালমাটিয়া, উত্তরা, বসুন্ধরা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী, আগ্রাবাদ ও নাছিরাবাদ এলাকায় ফ্ল্যাট ও ভবন কেনায় ২০০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ক্ষেত্রে কর দিতে হবে বর্গমিটারপ্রতি ৩ হাজার টাকা। ২০০ বর্গমিটারের বেশি হলে ৫ হাজার টাকা। এসব এলাকায় জমি কিনলে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ৮০০ টাকা। ১২০ থেকে ২০০ বর্গমিটারের মধ্যে হলে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ১ হাজার টাকা ও ২০০ বর্গমিটারে বেশি হলে কর দিতে হবে প্রতি বর্গমিটারে দেড় হাজার টাকা। এসব এলাকায় জমি কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। পৌরসভা এলাকায় ফ্ল্যাট ও জমি কিনতে ১২০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ৩০০ টাকা।

 ১২০ থেকে ২০০ বর্গমিটারের মধ্যে হলে প্রতি বর্গমিটারে কর দিতে হবে ৫০০ টাকা। ২০০ বর্গমিটারের জন্য দিতে হবে ৭০০ টাকা। এসব এলাকায় জমি কিনলে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১ হাজার টাকা কর আরোপ করা হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়, বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম চলমান আছে, সেখানে আনুমানিক এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এ পর্যন্ত ১৫ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়াও সেবাখাত, বিশেষত পর্যটন ও আবাসনখাতের এবং কৃষিখাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ প্রদানকে স্বাগত জানিয়েছে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। সংগঠনটি গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আবাসন খাতে নিবন্ধন ফি এবং স্ট্যাম্প ফি হ্রাস করার, প্রস্তাবের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। সরকারের এই যুগান্তকারী প্রস্তাবের ফলে আবাসন খাতে বিদ্যমান স্থবিরতা বহুলাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করে রিহ্যাব। এই বাজেটে সরকার আবাসন খাতে যে বিনিয়োগ সুবিধার প্রস্তাব করেছে, তা এই খাতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা যাতে ভাড়ার টাকায় মাথা গোঁজার একটা ঠিকানা খুঁজে পায় সেজন্য স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি একটি তহবিল গঠনসহ রিহ্যাব এর অন্য দাবিগুলো আগামীতে সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করছে রিহ্যাব।

সর্বশেষ খবর