শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
বিশ্লেষণ

অভিনব উপস্থাপনা বৈশিষ্ট্যহীন প্রস্তাবনা

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

অভিনব উপস্থাপনা বৈশিষ্ট্যহীন প্রস্তাবনা

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একটি বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরি করতে চেয়েছেন। যে কারণে তার ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক খাতের লক্ষ্যমাত্রাগুলো ২০১৮-১৯ থেকে সীমিত। কিন্তু বাস্তবতা আরও কঠিন। তাই আর্থিক কাঠামো আগের দুর্বলতাগুলো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়নি। যেমন রাজস্ব কাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যায় ২০১৮-১৯-এর সংশোধিত বাজেটে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আর আমরা প্রাক্কলন করেছি তা কম হবে ৮০ হাজার কোটি টাকার ওপর।

স্বাভাবিকভাবেই আগামী বছরের বাজেটের প্রাক্কলনের হিসাবের সূচনাবিন্দুটি ভ্রান্ত হয়ে গেল। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪৭ শতাংশ শেষ হবে তিন মাসের মধ্যে- কীভাবে তা হবে, তা আন্দাজ করা যায়। ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস এবং বৈদেশিক উৎসের ব্যাপারে যে সংশোধিত প্রাক্কলনগুলো আছে সেগুলো কিন্তু এই অতিক্রান্ত বছরের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন বলা হচ্ছে, আগামী বছর ৪৭ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়া হবে ব্যাংকগুলো থেকে। অথচ ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে আছে। আর এ টাকা সরকার নিতে গেলে ব্যক্তি উদ্যোক্তারা কী করবেন?

বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলার জন্য আর্থিক বা রাজস্ব পদক্ষেপের বাইরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অন্য অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয়নি। যেমন মুদ্রানীতি এবং বাণিজ্যনীতি এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক লেনদেনের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে টাকার বৈদেশিক বিনিময় হার সংশোধন করা দরকার। বলা হচ্ছে, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে, রেমিট্যান্স আয়ে ২ শতাংশ সুবিধা দেওয়া হবে- এসবই কিন্তু সরকারের আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করে। অথচ টাকার বিনিময় হার যদি ৩ শতাংশে নামিয়ে আনেন তা হলেই কিন্তু বেশি সুবিধা সব রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্সকারী পেতে পারেন। এটা আমাদের কাছে খুব আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের এ মুহূর্তের দুরবস্থার কোনো প্রকৃত চিত্র এই বক্তৃতায় পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছে অনাদায়ী ঋণ ও তারল্য সংকট। দেউলিয়া আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ সংকট সমাধান হবে না। এটি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার সঙ্গে জড়িত। ব্যাংক কমিশন গঠনের বিষয়টিকে সিদ্ধান্ত হিসেবে না নিয়ে আলোচনার বিষয় বলা ভালো, সময় ক্ষেপণের আরেক বুদ্ধি। আমরা যে তিনটি বিষয়ে বলেছিলাম রাজস্ব কাঠামো, বিনিময় হার এবং ব্যাংক খাতের সংস্কার- এ তিনটির প্রতিফলন বাজেট বক্তৃতায় কোথাও লক্ষ্য করিনি। বাংলাদেশে বিত্তশালীদের জন্য সারচার্জযোগ্য সম্পদের মাত্রা ছিল আড়াই কোটি টাকা। এবার সেটিকে তিন কোটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনিতেই ওই বিত্তগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে, প্রকৃত বাজারমূল্যে প্রতিফলিত নেই। এ আয়বৈষম্য-সম্পদবৈষম্যের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের কোনো প্রয়োজন ছিল বলে আমাদের মনে হয় না। তা ছাড়া আমরা ভ্যাটের ক্ষেত্রে দেখছি, ভ্যাটে যেসব ছাড় দেওয়া হচ্ছে তাতে ভ্যাট আহরণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন প্রচলনের ফলে হয়তো এ সূত্রে আয় কমবে। কিছু ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের ব্যয়কাঠামোয় চাপ বাড়ত। তবে বিভিন্ন কর পদক্ষেপ উচ্চবিত্তকে যেমনভাবে সুবিধা দিয়েছে নিম্নমধ্যবিত্তকে সেভাবে দেয়নি। যেমন করযোগ্য আয়ের সীমা বাড়ানো হলো না, কিন্তু সারচার্জযোগ্য সম্পদের সীমা আড়াই কোটি থেকে তিন কোটি করা হলো।

এ সরকার নতুন চিন্তা, নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে এ রকমটা মনে হয়নি। সবই প্রায় ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট বহু প্রতিশ্রুতি ছিল; কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, সেগুলো পূরণে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ দেখতে পেলাম না। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ এসেছে যা প্রশংসনীয়। তবে ২০৩০-এর ভিতরে তিন কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার যে আশ্বাস দেওয়া হলো তা কোন খাতে, কীভাবে হবে নির্দিষ্টভাবে বলা হলো না। অনেক ক্ষেত্রেই উপরি ভাসা প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু মূল্যায়নযোগ্য কর্মসূচি নেই।

তাই বলতে হয়, এবারের বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপনায় অভিনবতা আছে কিন্তু প্রস্তাবে সেটি ততটা নেই।

লেখক : বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি।

সর্বশেষ খবর