শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাজেট সুবিধাভোগীর পক্ষে গেছে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন সিপিডির

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজেট সুবিধাভোগীর পক্ষে গেছে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন সিপিডির

বাজেট নিয়ে সিপিডির মূল্যায়ন তুলে ধরেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

প্রস্তাবিত বাজেটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও ভোটারদের কাছে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পূর্ণ প্রকাশ হয়নি বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটির মূল্যায়নে- যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী এই বাজেট এবারও তাদের পক্ষেই গেছে।রাজধানীর লেকশোর হোটেলে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বিশ্লেষণ করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান।

বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা হিসেবে সিপিডির মূল বক্তব্য তুলে ধরার পর ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে গরিব মানুষের পক্ষে। এটি একটি সুগ্রন্থিত, সুলিখিত সুচিন্তিত দলিল। যারা এই ইশতেহার লিখেছেন, তারা নেন কিনা জানি না, আমি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি। এখানে বলা আছে- অন্তর্ভুক্তিমূলক সুষম সমাজ বিকশিত হবে আগামী দিনে।

অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি তো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য এগোচ্ছেন। যে সমাজে অসাম্য বাড়ছে, বৈষম্য বাড়ছে, সেই সমাজ আজ হোক, কাল হোক টিকে না। সে সমাজ এগোতে পারে না। সে সমাজে প্রবৃদ্ধির হারে পতন ঘটে। যেভাবে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, তাতে ৭, ৮, ৯ ও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি টিকানো কষ্ট হবে। আর বাংলাদেশ তো সৃষ্টিই হলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ওই বৈষম্য যদি দেশের ভিতর বাড়তে থাকে, তাহলে আগামীর বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশে কীভাবে পৌঁছাবে। গরিব মানুষের ছেলে-মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে বেশি। আপনাদের ছেলে মেয়েরা তো ঝরে পড়ে না। তিনি বলেন, আমরা জোর দিয়ে বলছি, সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া উচিত। আবার এগুলো বাস্তবায়ন করলে, পরে যে পরিবর্তন আসবে, সেই পরিবর্তনের ফলে যারা আহত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা এই পরিবর্তনগুলো করতে দেয় না। ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে এটা এত পরিষ্কার যে, যারা এটা থেকে অন্যায্য সুবিধা নিয়েছে, তারা এই পরিবর্তনগুলো আনতে দিতে চান না। তারা স্বচ্ছতা চান না। ব্যাংকিং কমিশন হলে পরে, তথ্য-উপাত্তের যে সমস্যাগুলো আছে, ওগুলো প্রকাশিত হলে যে হবে! এই দুশ্চিন্তা থেকেই তো ব্যাংকিং কমিশন করতে দেওয়া হবে না। শুধু স্বচ্ছতাকে ভয় পায় বলেই তো এগুলো করতে পারবে না। সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন- শুধু কি করের আওতা বৃদ্ধি করলেই হবে। অর্থ পাচার বন্ধে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ- করের টাকা তো বিদেশেও চলে যাচ্ছে। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। কালো টাকা বিনিয়োগ করতে দেবেন, এটা কেমন কথা! বৈপরীত্য হবে না? তাহলে তো পুরোটাকে একটা সামঞ্জস্যের মধ্যে আনতে হবে। পুরোটাকে সামঞ্জস্যের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রকাশ করতে পারেনি। কাজেই সুবিধাভোগীই নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজেটের রাজস্ব পদক্ষেপ যদি দেখি, এটা সচ্ছল উচ্চ আয়ের মানুষের অনেক বেশি সুবিধা দিয়েছে। আর গরিব মানুষের জন্য একটি প্রান্তিক এক ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বিকাশমান মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্তরা এই বাজেট থেকে বেশি উপকৃত হবেন না। কারণ, যে উন্নত মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রয়োজন, যারা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন না, লন্ডন-আমেরিকা গিয়ে যারা শিক্ষা গ্রহণ করাতে পারেন না, তাদের জন্য কী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

তাদের জন্য কী গণপরিবহন তৈরি করা হয়েছে? তাদের শিশুরা উচ্চমানের শিক্ষা পাচ্ছে কিনা, এটাই বড় বিষয়। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য আমরা কী করতে পারব, এটিই হচ্ছে বড় বিষয়। এটার ওপর নির্ভর করছে উচ্চ আয়ের দেশে যেতে আমরা কী করতে পারব। বিকাশমান মধ্যবিত্তই হচ্ছে চালিকা শক্তি। চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধিমত্তা, এটাই হলো- চালিকাশক্তি। সেই চালিকাশক্তিকে পরিপালন না করা ইশতেহারের চেতনার একদম পরিপন্থী। এটা রাজনৈতিক দলের শুধু আদর্শ না, তাদের ভোটের যে ভিত্তি, তারও পরিপন্থী।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, এক কথায় যারা অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, এই বাজেট এবারও তাদের পক্ষেই গেছে। কারণ, পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অথবা যে অর্থনৈতিক কৌশল দেখি, তা ইশতেহারে ছিল না। তা কিন্তু সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ছিল, এটা আমার দৃষ্টিতে বাস্তব। তার মতে, বাংলাদেশ একটা সীমান্ত রেখায় আছে। সীমান্তটাকে ঠেলে সামনে না নিলে বাংলাদেশের বিকাশের জায়গাটা আটকে যাবে। এটি হলো- দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের জায়গা। আমি নতুন অর্থমন্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় প্রজন্মের এই সংস্কার আশা করেছিলাম। সেই প্রত্যাশা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। তা হয়নি।

বাজেটের স্বচ্ছতার প্রসঙ্গ টেনে সিপিডির বিশ্লেষণে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা বার বার বলেছি, এনবিআরের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যের গরমিল আছে, পার্থক্য আছে। রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাত। বাজেটে আর্থিক স্বচ্ছতা কমে গেছে। সরকার যখন কোনো কর ছাড় দেয়, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে, মোট কত ছাড় দিল, কাকে ছাড় দিল। মোট কত কর আরোপ করল, কোন গোষ্ঠীর ওপর আরোপ করল। এই স্বচ্ছতা যদি না থাকে বাজেট কিন্তু স্বচ্ছ হলো না। এই স্বচ্ছতা আমরা পাই না। বাজেট স্বচ্ছতার অংশ হিসেবে নতুন অর্থমন্ত্রীকে এই স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করব। বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে যেসব তথ্য প্রতিবেদন আছে, তার ভিতর আমরা কিছু সামঞ্জস্যহীনতা খুঁজে পেয়েছি। নারীদের কী দিলেন, শিশুদের কী হলো, জেলা বাজেটের কী হলো, স্থানীয় সরকারে কী দাঁড়াল, তা পরিষ্কার করে বিভাজিত তথ্য দিতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ এই মুহূর্তে আছে সে বিষয়টি বাজেটে নেই। অর্থাৎ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী যে ধরনের অভিনবত্ব দেখিয়েছেন, বাজেট প্রস্তুতির ভিতর সে অভিনবত্ব দুঃখজনকভাবে খুঁজে পাইনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ধরে ধরে বাজেট প্রস্তুত হয়েছে বলে মনে হয় না। গৎবাঁধা কিছু ভালো কথা থাকে, সেগুলো আছে। তার মতে, তিন কোটি কর্মসংস্থান হবে, কোন খাতে, কোন বছরে কত হবে, তার কোনো প্রাক্কলন নেই। এক কোটি নতুন করদাতা তৈরি করার ক্ষেত্রে কোন সালে কত হবে, কেমন করে হবে, তার কোনো কর্মসূচি নেই। এগুলো বাতাসের ভিতর কিছু আশ্বাসের বাণী হয় তো গেছে। আমরা মনে করি না- এগুলো বাস্তবভাবে এসেছে।

সিপিডি বলেছে, আমরা কিছু কাঠামোগত সংস্কারের কথা বার বার বলে আসছি। ব্যাংকিং খাতের কথা তো পরিষ্কারভাবে বললাম। এটা তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা। সেটা না করে একটা আলোচনার জায়গায় চলে গেল ব্যাংক কমিশনের বিষয়টি। কোনো সংস্কারের প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পুরো উন্নয়ন কর্মসূচি দাঁড়িয়েছে সরকারি টাকায় অবকাঠামো তৈরি করা। অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের চিন্তার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু বাংলাদেশের গরিব মানুষের ভিতরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সক্ষমতা, তা তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না। এমনকি ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ছে না। এর ফলে সামাজিক সক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং আয়-বৈষম্য বাড়ছে। এমনকি ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়ছে। এটা কোনো টেকসই ব্যবস্থা নয়।

সামষ্টিক বাজেট কাঠামো বিশ্লেষণে সিপিডি বলেছে- নতুন বাজেটে কৃষককে ধানের লোকসান বাবদ প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো হয়নি। কিন্তু সম্পদের সারচার্জের সীমায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। ধনীরা ফ্ল্যাট কিনতেও কর ছাড় পেয়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকরাও নগদ ভর্তুকি পেয়েছে। অর্থমন্ত্রী এবার অনেক লক্ষ্যের ক্ষেত্রেই বাস্তবমুখী হয়েছেন। ফলে আগের দু-একটি বছরের তুলনায় রাজস্ব ও বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা কম। করবহির্ভূত আয় বাড়ানোর উদ্যোগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে উন্নয়ন ব্যয় ৭ শতাংশ রাখা, শত শত নতুন প্রকল্প না নেওয়াসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রীকেও সাধুবাদ জানিয়েছে সিপিডি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কি কি ছিল, বাজেটে তার কোন বিষয়ে কি- সেই কথাও উঠে এসেছে সিপিডির পর্যালোচনায়। সিপিডি বলেছে- এবারে বাজেটের আকার টাকার অঙ্কে বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে বাড়েনি। লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাস্তবায়নের পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে। বাজেটে ঘাটতি ৫ শতাংশের ওপরেই আছে। এবার তা বাড়বে কি না রাজস্ব আহরণের ওপর নির্ভর করবে। জনপ্রশাসনে এবার কেন মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হলো, সেই প্রশ্ন তুলে সিপিডি বলেছে- দায়দেনা পরিস্থিতি গুরুতর আকার নিতে পারে। ব্যাংকিং খাতের ভূমিকার ক্ষেত্রে নতুন কিছু পাচ্ছি না। বৈদেশিক আয়-ব্যয়ে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে, বাজেটে সেই বিষয়ে কোনো সচেতনতা লক্ষ্য করছি না।

 

সর্বশেষ খবর