শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনিশ্চিত জীবন বিহারিদের

পাকিস্তানে যেতে চায় না নতুন প্রজন্ম, ঝুপড়ি ঘরে বসবাস, নেই শিক্ষা-চিকিৎসাসেবা ঢাকা থেকে ক্যাম্প সরানোর উদ্যোগ থমকে আছে

গোলাম রাব্বানী ও জিন্নাতুন নূর

অনিশ্চিত জীবন বিহারিদের

অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়ি ঘরেই বসবাস বিহারিদের -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা (যারা এদেশে ‘বিহারি’ নামে পরিচিত) ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এরা উর্দুভাষী। এদের বেশিরভাগই কসাইখানায়, সেলুনে, খাবারের দোকানে কিংবা দিনমজুরের কাজ করেন। কেউ রিকশা বা অটোরিকশা চালান। একটি বড় অংশের রোজগার আসে কাপড় সেলাই বা হাতের কাজ করে। অনেকে কাজের সন্ধানে ছোটাছুটি করেও কাজ পাচ্ছেন না। বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানির (বিহারি) সংখ্যা ৫ লাখের ওপরে, এদের সাড়ে তিন লাখের বসবাস বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে। মোহাম্মদপুরে প্রায় ৩৫/৪০ হাজার বিহারি ভোটার রয়েছে। আর মিরপুরে বিহারি ভোটারের সংখ্যা ৬০ হাজার। বিহারিরা মনে করেন, ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও তারা  অনেক নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকটাই অনিশ্চিত জীবন তাদের।

ঝুপড়ি ঘরে বসবাস : মোহাম্মদপুরের ক্যাম্পে এক একটি ঝুপড়ি ঘরে দশ-পনেরোজন বসবাস করেন। সরেজমিন দেখা যায়, একটি কামরার ভিতরে রান্না, খাওয়া, ঘুম। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে রাখা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। প্রায় সব ঘরেই একই চিত্র। এ ছাড়াও একই গোসলখানায় একাধিক নারী কিংবা একাধিক পুরুষকে গোসল করতে দেখা গেছে। এক বাসিন্দা বলেন- স্বামী, ছেলে, ছেলে-বউ, মেয়ে, নাতি নিয়ে একই ঘরে থাকি। লজ্জাজনক ব্যাপার! তবু এভাবেই থাকতে বাধ্য হচ্ছি। এই বাসিন্দা বলেন, চার থেকে পাঁচটি গলির লোকের জন্য সাতটি শৌচাগার। মহিলাদের জন্য তিনটি আর পুরুষদের চারটি। সকালে কিংবা রাতে যখন লোকজনের তাড়াহুড়ো থাকে তখন শৌচাগারের সামনে লম্বা সিরিয়াল পড়ে যায়। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এই ক্যাম্পে এক থেকে দেড় লাখ লোকের বাস। এত লোক গাদাগাদি করে থাকতে গিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটিও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বেশ কিছু বিহারিকে ভোটাধিকারের সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের সবচেয়ে বড় ক্যাম্প হচ্ছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের বাসিন্দাদের চিকিৎসা, পয়োনিষ্কাশন ও গ্যাসের মতো নাগরিক সেবার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তারা জানান, ক্ষেত্রবিশেষে নাগরিক সুবিধা পেতে বিহারিদের নিজের পরিচয়ও লুকিয়ে রাখতে হয়। ক্যাম্পের ভিতর পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এই জনগোষ্ঠী। জেনেভা ক্যাম্পের বয়স্ক ব্যক্তিরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া উর্দুভাষীদের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) একত্রিত করে। তাদের একটি অংশের জায়গা হয় মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে। সে সময় প্রতিটি অবাঙালি পরিবারের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে আইসিআরসি ৮ ফুট বাই ৮ ফুটের টিনশেড বাড়ি তৈরি করে দেয়। কালক্রমে টিনশেড বাড়ি এখন পাকা ঘরবাড়ি। সরু গলিতে এক-একটি একতলা বাড়িয়ে তারা দ্বিতল বাড়ি তৈরি করেছেন। আর আইসিআরসির পর ক্যাম্পের দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তিয়েছে।

বাসস্থান সংকটে আছে মিরপুর কালশীর কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বিহারিরাও। প্রথমে কুর্মিটোলা (বগুড়া ক্যাম্প)-এ বসবাস শুরু করলেও জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাস্তা পার হয়ে এই ক্যাম্পটি এখন পূর্ব কুর্মিটোলা নামে আরেকটি ক্যাম্পের জন্ম দেয়। এই ক্যাম্পের উঁচু-নিচু স্থানে সরু গলিগুলোর-ভিতর ময়লা-দুর্গন্ধময় পরিবেশে এক-একটি ঘরে একসঙ্গে অনেকজন বাস করেন। এই ক্যাম্পের অনেক ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হলেও তারা শুধুমাত্র বিহারি পরিবারে জন্ম নেওয়ায় চাকরি পাচ্ছেন না। আবার দরিদ্র এই মানুষগুলো চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তারের বদলে ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কেনার ওপর নির্ভরশীল। এই ক্যাম্পে বাংলাদেশ বিহারি পুনর্বাসন সংসদ নামের একটি সংগঠন আছে। সংগঠনটি বিহারিদের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করে। এর সভাপতি ওসমান গনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা বাংলাদেশেই থেকে যেতে চাই। কিন্তু বর্তমানে আমাদের থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো রকম সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ প্রয়োজনে আমরা নিজেরাই টাকা তুলে সমস্যার সমাধান করি। আমাদের কাজেরও খুব অভাব। ছেলেমেয়েরাও সম্মানজনক কোনো কাজ করতে পারছে না।           

পাকিস্তানে যেতে চায় না নতুন প্রজন্ম : আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সে দেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেমে গেছে। ইতিমধ্যেই উর্দুভাষী এসব লোকের শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ ভোটার হওয়ায় জটিলতা আরও বেড়েছে। বেশিরভাগ বিহারিই এখন পাকিস্তানে যেতে নারাজ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এদেশে থেকেই ভালো কিছু করতে চায়। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় বিহারি সমস্যা দিন দিন জটিল আর প্রকট হচ্ছে। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে ঢাকার ক্যাম্পগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বহুতল পাকা বাড়ি উঠছে। যে কোনো সময় এসব বাড়ি ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পের বয়স্করা জানান, দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে থাকার কারণে তারা এখন পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বিহারিরা যারা বাংলা-উর্দু দুই ভাষাই রপ্ত করেছে এবং স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে মিশে গেছে তারা। বয়স্কদের দু-একজন অবশ্য আক্ষেপ করে জানান, পাকিস্তান সরকারের অনাগ্রহের কারণে তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।

বিহারিরা কত? : আটকে পড়া পাকিস্তানি তথা বিহারিদের প্রতিনিধিত্ব করতে ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর এসপিজিআরসি (স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি) নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরে এসপিজিআরসি ১৯৯২ সালে মক্কাভিত্তিক রাবেতা আল ইসলাম নামে একটি এনজিওর সঙ্গে যৌথভাবে বিহারিদের ওপর জরিপ চালায়। ওই জরিপ অনুযায়ী- দেশের ১৭ জেলায় ৭০টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ছয়টি ও মিরপুরে ২৫। বাকি ৩৯ ক্যাম্পের মধ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর ও নীলফামারীতে একটি করে, নারায়ণগঞ্জে ৩, যশোরে ৯, রংপুরে ২, রাজশাহীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, ঈশ্বরদীতে ৪ ও খুলনায় রয়েছে পাঁচটি। জরিপ অনুযায়ী ওই সময় ক্যাম্পের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ সাড়ে ৩৭ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে সৈয়দপুরে ক্যাম্পের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে মোহাজির ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের আর একটি সংগঠন আটকে পড়া পাকিস্তানি নিয়ে কাজ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী ১১৬ বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছেÑ ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, খুলনা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, নড়াইল, বরিশাল, বরগুনা ও সিলেট।

যে উদ্যোগ থমকে আছে : আবাসনের অসুবিধা, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও মানবিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রাজধানী ঢাকার বিহারি ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেই কাজ অনেকটা থমকে আছে। ঢাকার আশপাশে সুবিধাজনক স্থানে এগুলো স্থানান্তরের কথা ছিল। এজন্য প্রাথমিকভাবে গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জের দুটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।

 তবে তা চূড়ান্ত করা হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব জানা গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় অবাঙালি বিহারিদের ক্যাম্পগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের এ আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা বিতর্ক চলে আসছে। বিহারি ক্যাম্পগুলো নানা অপরাধের ঘাঁটি এবং আশপাশের এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। দেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানেও মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্প থেকে মাদকসহ একাধিক অপরাধীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি কলোনিগুলোতে বিহারিরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

বিহারিদের সংগঠন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট (ইউএসপিওয়াইআরএম) সভাপতি  সাদাকাত খান ফাক্কু বলেন, কালশীতে ১০ বিহারি হত্যাকাে র বিচার আজও হয়নি। কোনো অগ্রগতিও নেই। এই হত্যাকাে র পর আমরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছিলাম। এর মধ্যে আমাদের পুনর্বাসন করার দাবিও ছিল। এর পর আমরা জেনেছি প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নির্দেশনাও দিয়েছেন। এর জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা একটি কমিটিও গঠন করে। কিন্তু জমি খুঁজে পাচ্ছে না। তার দাবি বিহারির সংখ্যা ৫ লাখ হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর