স্বাধীনতার পর বিগত চার দশকের বেশি সময়ে দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মেডিকেল কলেজ, ক্লিনিক, বিশেষায়িত হেলথ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গড়ে উঠেছে প্রান্তিক পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে রাজধানীকেন্দ্রিক ঝকঝকে তকতকে পাঁচতারকা মানের হাসপাতালও। তবু এখনো সাধারণ মানুষের শেষ ভরসার স্থল ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক)। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও গড়ে ওঠেনি ঢামেকের সমকক্ষ কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।
৭৩ বছর ধরে সামর্থ্য অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়ে শুধু রোগী নয়, অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে এই হাসপাতালটি। সুদূর মফস্বল বা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুধু রোগীরা ছুটে আসে না, মুমূর্ষু বা জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢামেকে। রাত-বিরাতে জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য রাজধানীর অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে মানুষ ছুটে আসে এখানে। আবার অন্য হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো দায়িত্ব না নেওয়ায় দুর্ঘটনা, ছুরিকাঘাত, বিষপান, গুলিবিদ্ধÑ এসব রোগীর অধিকাংশের জায়গা হয় এই ঢাকা মেডিকেলেই। এ ছাড়া অগ্নিকা-, সন্ত্রাসী হামলা বা আন্দোলনে হতাহত, অজ্ঞাত মৃতদেহ, খুনের ঘটনা, জেলা কারাগারের রোগী- সব কিছু দেখভালের দায়িত্ব যেন শুধু এই হাসপাতালটিরই। এতে দেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ঢামেক হাসপাতালের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বেড়েই চলেছে। পর্যাপ্ত শয্যা না থাকায় রোগীর জায়গা হচ্ছে করিডর, বারান্দা ও ওয়ার্ডের মেঝেতে। হেলথ কেয়ার গ্লোবালের প্রতিবেদনে ভারতের ২৮০০ শয্যার আহমেদাবাদ সিভিল হসপিটালকে এশিয়ার বৃহত্তম পাবলিক হাসপাতাল বলা হলেও দেখা গেছে সেখানে বছরে গড়ে ভর্তি হচ্ছে ৭০ হাজার রোগী। সার্জারি হয় ২৬ হাজার। অন্যদিকে ঢামেকে গত বছরই ভর্তি হয় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৮ রোগী। ছোট-বড় মিলিয়ে সার্জারি হয় ৬৮ হাজার ২৯টি। ঢামেক কর্তৃপক্ষ বলছে, নামমাত্র খরচে ভালো চিকিৎসা পেতে সারা দেশ থেকে এখানে রোগী আসছে। এ ছাড়া দায়িত্ব এড়াতে বা পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় অনেক নামকরা হাসপাতালও সংকটাপন্ন রোগীকে ঢামেকে রেফার করে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে ছুরিকাঘাত, গুলিবিদ্ধ, বিষপানÑ এসব রোগীর ভর্তি নিচ্ছে না অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক। সবাই আসছে ঢামেকে। ফলে এখানে রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। হাসপাতালটিতে ৮৫০ জন অনারারি চিকিৎসক, ২০৭ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক, দুই হাজারের ওপর নার্স সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গভীর রাতে যতজন সিনিয়র চিকিৎসক এখানে থাকেন, অনেক হাসপাতালে হয়তো ততজন নার্সও থাকেন না। এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যত সংকটই থাকুক, আমরা কাউকে ‘না’ বলি না। এজন্য ঢামেকে প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। ২০১৮ সালে ইনডোর, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮১৬ জন রোগী ঢামেক থেকে চিকিৎসা নেন। আগের বছরের তুলনায় ৯৪ হাজার ৪৬৯ জন বেশি। গত চার বছরের ব্যবধানে এখানে রোগী বেড়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৩২ জন। জরুরি বিভাগেই দৈনিক ১২০০ থেকে ১৫০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যা একক হাসপাতাল হিসেবে শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বের মধ্যে বিরল। বর্তমানে বহির্বিভাগে দৈনিক ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। বারান্দায়-মেঝেতে রোগীর অবস্থান প্রসঙ্গে এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ২ হাজার ৬০০ শয্যার হাসপাতালটিতে সব সময় ৪ হাজারের ওপর রোগী ভর্তি থাকছেন। দৈনিক সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন প্রায় ৫৫০ রোগী, ভর্তি হচ্ছেন ৬৫০-৭০০। সবাইকে বেড দিতে পারছি না। সারা দেশ থেকে রোগী আসছেন। ২৫ ভাগ আসছেন বিভিন্ন হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে রেফারের মাধ্যমে। অনেকে অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে আসছেন। ফিরিয়েও দিতে পারছি না। আমরা ফিরিয়ে দিলে তারা যাবে কোথায়? তবে পাঁচ-ছয়টি ১৬ তলা কমপ্লেক্স করা হচ্ছে। এগুলো হতে কয়েক বছর সময় লাগবে। তখন শয্যা সংকট আর থাকবে না। তিনি বলেন, ঢামেক হাসপাতাল শুধু সারা দেশের মানুষের আস্থার জায়গাই তৈরি করেনি, দেশের যে কোনো জরুরি মুহূর্তে ঢামেক ঢাল হিসেবে পাশে দাঁড়াচ্ছে। বনানীর অগ্নিকা-ের সময় তাৎক্ষণিক নির্দেশে হাসপাতালের আশপাশে থাকা ২০টির মতো বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে হতাহতদের নিয়ে আসা হয়। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগলে সবগুলো অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে প্রায় আড়াইশ রোগীকে এখানে এনে চিকিৎসা দিয়েছি। অপ্রতুল সুবিধার কারণে অনেক রোগীকে কষ্ট করতে হচ্ছে উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন বলেন, এখানে আইসিইউতে ৩৩টি, এনআইসিইউতে ৩০টি শয্যা আছে। কিন্তু চাহিদা থাকে তিন-চারগুণ। অ্যাম্বুলেন্স দরকার ৩৫-৪০টি। আছে ৬টি। তাও ঠিকমতো চালাতে পারি না চালক সংকটে। এখানে মর্গ ও মরচুয়ারিতেও সব সময় চাপ থাকে। হাসপাতালের মরচুয়ারিতে ১২টি লাশ রাখার জায়গা আছে। কলেজ শাখার মরচুয়ারির কারণে কোনোরকমে সামাল দিতে পারছি। জনবল ঘাটতি আছে প্রায় ৭০০। হাসপাতালের পরিবেশ, সিট না-পাওয়া নিয়ে অনেকের অভিযোগ থাকতে পারে; কিন্তু অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা নিয়েও এত রোগীর সেবা দেওয়া এমন হাসপাতাল সারা বিশ্বে আর একটিও মিলবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, অধিদফতরের অধীনে সরকারি ১৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১০টি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ৮টি জেনারেল হাসপাতাল, ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতাল, ৪২৪টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১৩ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ ২০ হাজার ৭২৫টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব মিলে শয্যাসংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৬৯টি। ২০১৮ সালে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নেন ৪ কোটি ৯২ লাখ ৩৪ হাজার ৭৮৫ জন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলেই চিকিৎসা নেন ৯ লাখ ৯০ হাজার ৪৪৮ জন (৪ শতাংশ)। অন্যদিকে সারা দেশে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন ৮৫ লাখ ৯৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে নেন ৪ লাখ ৭০ হাজার ৭৮০ জন (৫.৪৭ শতাংশ)। ২০১৮ সালে সারা দেশে মেজর সার্জারি হয় ৩ লাখ ৬৯৩টি। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলেই হয় ২৮ হাজার ৩৫টি। চট্টগ্রাম মেডিকেলে হয় ১৫ হাজার ৮৩৬টি, রাজশাহী মেডিকেলে হয় ১৭ হাজার ২২৭টি, খুলনা মেডিকেলে হয় ৬৪৮টি, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে হয় ৮ হাজার ৩৪৮টি। দেশের যে কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তুলনায় ঢাকা মেডিকেলে সার্জারির হয় দুই থেকে চারগুণ বেশি। এদিকে শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে মানুষের আস্থার জায়গা নয়, হাসপাতালটি ঘিরে তৈরি হয়েছে অন্তত ১০ হাজার মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা, ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, অস্থায়ী খাবারের দোকান, হকার, ঠিকাদার, লন্ড্রি ব্যবসা, গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে অন্তত ৩০ ধরনের ব্যবসা ও কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে হাসপাতাল ঘিরে। এত ইতিবাচক দিকের মধ্যেও রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সিট বাণিজ্য, ট্রলি বাণিজ্য, হুইলচেয়ার বাণিজ্য, টেস্ট বাণিজ্য, রক্ত বাণিজ্য, আইসিইউ বাণিজ্য, অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য হাসপাতালটিকে সর্বদা বিতর্কের মধ্যে রেখেছে। হাসপাতাল পরিচালক বলেন, হাতেনাতে এসব অপরাধে কাউকে ধরতে পারলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দীর্ঘদিনের পথযাত্রায় দেশের মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। দিন-রাতের যে কোনো সময় জরুরি সেবা পেতে এই হাসপাতালে ভিড় জমায় মানুষ। তবে দূর-দূরান্তের রোগীদের ভোগান্তি কমাতে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দুর্ঘটনায় কিংবা দুষ্কৃতকারীর হাতে আহত রোগীর দায়িত্ব না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিকিৎসকের কাজ মানুষের জীবন রক্ষা। অনেক সময় আইনি জটিলতার কথা চিন্তা করে হাসপাতালগুলো এসব রোগী ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। এতে আহত ব্যক্তির জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এ ধরনের রোগীকে মানবিক বিবেচনায় সেবা দিতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের বিষয় মোকাবিলায় হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিএমএর সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, অন্যতম ভরসার জায়গা হওয়ায় সারা দেশের সব ধরনের রোগী ঢামেকে ছুটে আসে। এজন্য ঢামেকে চাপ বেড়েই যাচ্ছে। রোগীর চাপ কমাতে রেফারেন্স পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে সেবা নেওয়া রোগীর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসক তাকে উপযুক্ত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন কী ধরনের চিকিৎসা কোন হাসপাতালে ভালো হবে। জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরা দিকনির্দেশনা দিলে সব রোগীকে ঢাকা মেডিকেলে আসার প্রয়োজন পড়বে না।