শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
ইতিহাসের মুখোমুখি আমির হোসেন আমু

রাজ্জাক তো সিরাজের বিরোধিতা করেছিলেন, অচেনা আরেফকে নিয়ে নিউক্লিয়াস হয় কী করে?

পীর হাবিবুর রহমান

রাজ্জাক তো সিরাজের বিরোধিতা করেছিলেন, অচেনা আরেফকে নিয়ে নিউক্লিয়াস হয় কী করে?

আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ষাটের দশকের ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আমির হোসেন আমু রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খানের জবানবন্দিতে লেখা, ‘আমি সিরাজুল আলম খান বইয়ে বর্ণিত ইতিহাসের অংশবিশেষকে কল্পনাপ্রসূত, মনগড়া, আমিত্বের আষাঢ়ে গল্প বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তার ধারাবাহিক বর্ণনায় বলেছেন, ‘শেখ ফজলুল হক মণির খবরে বরিশাল থেকে ঢাকায় গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় গাইডলাইন নেন। পরদিন শেখ মণিসহ মোহাম্মদ ফরহাদের সঙ্গে দেখা করেন। ফরহাদ তখন ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কমরেড ফরহাদ নামে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।  কমরেড ফরহাদ দেখা হওয়া মাত্রই হেসে বললেন, আপনি বরিশাল চলে যান সেখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেবেন। বরিশাল ফিরে আসার দুই দিন পর যখন ঢাকা থেকে আবার খবর এলো যাওয়ার, ছুটে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেব দ্রুত গ্রেফতার হবেন। গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বললেন, ‘মানিক ভাই (ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা) ধারাবাহিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লিখবেন। তোরা এসব ছাত্রের মধ্যে পাঠচক্রের মাধ্যমে মোটিভেশন করবি।’ আর মনে রাখিস, বরিশালের পুলিশ সুপার ?এবং ডিআইও আমার নিজের লোক। তাদের সঙ্গে দেখা করবি। দুজনই আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের বলা আছে, সহযোগিতা করবেন।

বরিশালে ফিরে আমির হোসেন আমু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বি এম কলেজ ছাত্র সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের দখলে। বরিশালে তখন এক্সিবিশন (মেলা) চলছিল। বি এম কলেজের ছিল ৬টি স্টল। আর স্টল ঘিরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গেটপাস ছিল। হঠাৎ এক বিকালে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি চারদিকে হট্টগোল শুনলেন। ভাইস প্রিন্সিপালকে গেটপাস না থাকায় নিরাপত্তা পুলিশ ধাক্কা দিয়েছে এবং প্রবেশ করতে দেয়নি। এটা শুনে বারেককে বললেন, ছাত্র ধর্মঘট কর্মসূচি দেব। পরদিন কর্মীদের দিয়ে স্কুল থেকে ছাত্র ধর্মঘট মিছিলের ব্যবস্থা করা হলো। কলেজে সকালে গিয়ে ছাত্র ধর্মঘট শুরু হলো। কিন্তু স্কুলের ছাত্ররা বি এম কলেজে আসার পথে পুলিশ বাধা দিল, তখন তারা কী করবে এই পরামর্শ চাইলে কোনো অঘটন যাতে না ঘটে সেজন্য ফিরে যেতে বলা হলো। তখন নূর মোহাম্মদ বরিশালের ডিসি। তিনি প্রিন্সিপালকে টেলিফোন করে বিস্তারিত জানলেন এবং পুলিশ সুপারকে নিয়ে কলেজে আসার প্রস্তাব দিলে হিতে যাতে বিপরীত না হয়, সেটি প্রিন্সিপাল অবহিত করলেন। তারা এলে আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে সভা করলেন। সেখানে ‘মুক্তির ও মন্দির সোপানও তলে, কতপ্রাণ হলো বলিদান’ গানটি পরিবেশন করা হলো। ডিসি সাহেব গানটি মন দিয়ে শুনলেন। সবাই? পুলিশ সুপার  ও ডিসি নূর মোহাম্মদ ভাইস প্রিন্সিপালের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। ?যাওয়ার সময় ডিসি আমির হোসেন আমুর কাছে জানতে চাইলেন, যে গানটি পরিবেশিত হলো সেটি কি অনুষ্ঠানে খাপ খায়? জবাবে আমু বললেন, আজ না হলে কাল হয়তো খাপ খাবে। তিনি একটু ভ্রু কুঁচকে চলে গেলেন।

কয়েকদিন পরে এক্সিবিশন মাঠে যাওয়ার জন্য রিকশায় চড়তেই দেখেন চারদিক ফাঁকা। কারণ কী জানতে চাইলে, রিকশাচালক বললেন; আপনাদের নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি তখন জানতে চাইলেন, তোমাদের নেতা কে? রিকশাচালক জবাবে বলল, হক সাহেব। ‘শেরে বাংলা’ ও ‘হক সাহেব’ নামেই একে ফজলুল হক বাঙালিদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতারের খবরে মাথাটা ঘুরে গেল। এক্সিবিশন মাঠে যেতেই ?পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার দুজন লোক তাদের রিসিভ করল। হাউজিতে প্রবেশ করলে তারা পয়সা দিয়ে দেয়। অর্থাৎ তাদের পিছু ছাড়ছিল না। ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেত্রী দেবী চক্রবর্তী ও জাফি লেডিস কর্নারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমুর ভাষায়, তাকে দেখেই কোনো দিন কথা না বললেও তারা সেসময় বলে উঠল, আপনি না আমাদের ঘুরাবেন, খাওয়াবেন; সবাই অপেক্ষা করছে। কই আপনার খোঁজই নাই তো? তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দুজন ৫০ টাকা দিয়ে বলল, যান যান তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। তারা মনে করল, ছাত্রীদের পেয়ে আমরা হয়তো গল্প-গুজবে থাকব। এতে তারা স্বস্তি নিয়ে চলে গেল। তারা যাওয়ার পর ওরা দুজন বলল, ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা নদীতে নৌকায় অপেক্ষা করছেন। আপনি গোয়েন্দাদের নজরে আটকে আছেন দেখে, নিতে এসেছি। তাদের সঙ্গে নৌকায় গিয়ে আলোচনা শুরু করতেই ছাত্র ধর্মঘটের প্রস্তাব দিলাম।

আমির হোসেন আমু বললেন, সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করলে তিনি হিরো হয়ে যাবেন। এই আশঙ্কায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা ছাত্র ধর্মঘটে রাজি হলো না। তারা সময় চাইল। আমি রাজি হয়ে যাওয়ায় বারিক ক্ষেপে গেল। বারিককে বললাম,  আমাদের কর্মীদের দিয়ে ছাত্র ধর্মঘট করিয়ে দেব। স্কুলগুলো থেকে সংগঠিত করে মিছিল নিয়ে আসবে। এক্সিবিশনে ফিরে এসে ফের পুলিশের সেই গোয়েন্দাদের নজরে পড়লাম। বাসায় আসা পর্যন্ত পুলিশ নজরবন্দি করে রাখল। ঘণ্টাখানেক পর যখন বুঝলাম তারা চলে গেছে তখন সাইকেল নিয়ে হোস্টেলে চলে গেলাম। তার পেছনেই মাহবুবদের বাসা। ওদের খবর দিয়ে আনালাম। ছাত্রলীগের সবাইকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়ে স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে আসার নির্দেশনা দিলাম। পরদিন সকাল ৮টায় কলেজে এসে মাঠের মধ্যে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসে বললাম, ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়ন এতে মন খারাপ করল। স্কুল ছাত্রদের মিছিল পুলিশ আটকে দিলে তাদের আবার ফিরে যেতে বলা হলো। ছাত্র ইউনিয়ন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি যুক্ত করলে মেনে নেওয়া হলো। পরদিন আমরা এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবিতে কলেজে ধর্মঘট দিলাম। কলেজ থেকে পরদিন মিছিল নিয়ে বের হলে বাজারে পুলিশ বাধা দিল। আমরা সেখান থেকে যার যার মতো নিরাপদে চলে গেলাম। পরদিন খবর এলো বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের সাহেব বরিশালে আমার বাসায় গিয়ে হৈচৈ করছেন। দেখা করার জন্য খবর দিতে বলেছেন। উনার কাছে চিঠি দিলাম, আমার লোক যেখানে নিয়ে আসবে, সেখানে তিনি সন্ধ্যার পর আসলে দেখা হবে। তিনি নির্ধারিত স্থানে ওয়াপদার সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের জিপ নিয়ে এসে গাড়িতে তুললেন। বললেন, যা করছ, আইয়ুবের বেত খাবা। তিনি জানতে চাইলেন, ভাইজান বলেছিলেন পুলিশ সুপার ও ডিআইওর সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করেছিলে? না বলতেই রেগে দিয়ে বললেন, বেশি বুঝ? ওয়াপদার সুপারিনটেনডেন্টের বাসায় নিয়ে আসলেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ সুপার সেখানে এলেন। রেগে গিয়ে বললেন, দেশের কোথাও  কোনো ধর্মঘট  নেই। আপনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে  এখানে ধর্মঘট করছেন। ঢাকায় যদি কাল ধর্মঘট হয়, তাহলে পরশু এখানে নামবেন। না হয়, নামবেন না। এমন হলে দুজনই বিপদে পড়ব।

নাসের ভাই যে কদিন আছেন উনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। পুলিশ সুপার খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বললেন। যাওয়ার সময় সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীর হাতে একটি প্যাকেট দিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন বেরিয়ে আসব, তখন ভদ্র মহিলা সেই প্যাকেটটি আমার হাতে দিলেন। যার  ভেতরে আন্দোলনের জন্য অর্থ সহায়তা ছিল। পরদিন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম, যেখানে ন্যাপের সেক্রেটারি সৈয়দ আশরাফ সাহেবও ছিলেন। বিস্তারিত আলোচনা করে আমরা আমাদের কমর্সূিচ স্থগিত করলাম। সপ্তাহখানেক পর শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র সমাজের মিছিল প্রেস ক্লাব পর্যন্ত গেল। শেখ ফজলুল হক মণি সেখানে সোহরাওয়ার্দীসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবিতে বক্তৃতা করলেন।  আমরাও পরদিন ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করলাম। অশ্বিনী কুমার টাউন হলের নাম পরিবর্তন করে আইয়ুব খান টাউন হল করা হয়েছিল। সেটি ভাঙচুর করে আবার অশ্বিনী কুমার করা হলো। কায়েদ-ই-আজম ও লিয়াকত আলী খানের নামে স্থাপিত দুটি গেট গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। শহরের দোকানপাটে কায়েদ-ই-আজমের ছবি ভাঙচুর করা হলো। ধরপাকড়ের চেষ্টা যেমন চলল, সারা দেশে আন্দোলনও ছড়িয়ে পড়ল।

আমির হোসেন  আমু বলেন, এর মধ্যে কয়েকদিন পর হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট বের হলে সারা দেশের মতো বরিশালেও লাগাতার স্কুল-কলেজ ধর্মঘট ও ছাত্র মিছিলে আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠল। ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গুলিবর্ষণের পর বরিশালেও পুলিশ গুলি চালাল, তবে কেউ হতাহত হয়নি। এর মধ্যে আমির হোসেন আমু ২৫টি মামলা খেলেন, তিনবার গ্রেফতার হয়ে জামিনে মুক্তি পেলেন। কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কনভোকেশনে  মোনায়েম খান আসবেনÑএই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে শেখ ফজলুল হক মণি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে  তোলেন। এতে শেখ ফজলুল হক মণি ও আসমত আলী সিকদারের এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হলো।  এই নিপীড়নের প্রতিবাদে হরতাল ও মিছিল হলো বরিশালেও।

সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা তখন কোথায় ছিল এই প্রশ্ন রেখে আমির হোসেন আমু বলেন, ঢাকা কলেজ থেকে ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়ায় আবদুর রাজ্জাককে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অনেকে চিনলেও কাজী আরেফকে কেউ চিনতই না। ’৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান মাঠে (আরমানিটোলা মাঠ) ছাত্রলীগের সম্মেলনে সারা রাত বাগ্বিত ার পর সমঝোতার ভিত্তিতে ভোরবেলা কে এম ওবায়দুর রহমানকে সভাপতি ও সিরাজুল আলম খানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষিত হলো। সেই কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক করা হলো আবদুর রাজ্জাককে। আবদুর রাজ্জাক তখন দাঁড়িয়ে সিরাজুল আলম খানের সাধারণ সম্পাদক হওয়া নিয়ে চরম বিরোধিতাই করেননি, তিনিসহ ১১ জনের নাম কমিটি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কত হাস্যকর ব্যাপার যে, সিরাজুল আলম খান তার বিরোধিতাকারী রাজ্জাক আর অচেনা কাজী আরেফকে নিয়ে গায়েবি নিউক্লিয়াস তত্ত্ব হাজির করেন। যার কোনো অস্তিত্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম দূরে থাক, ছাত্রলীগের ইতিহাসের কোথাও নেই। এমনকি এর কোনো তথ্য-প্রমাণ তার নিজের কাছেও নেই।...(চলবে)

সর্বশেষ খবর