শিরোনাম
রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বিহারিদের হাতে

স্বামী-স্ত্রী মিলেই চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা, শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে খুচরা বিক্রির কাজে

গোলাম রাব্বানী ও জিন্নাতুন নূর

দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়া পাকিস্তানি তথা বিহারিদের অধিকাংশ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেক এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও এখন তাদের হাতে। নজরদারি অপেক্ষাকৃত কম থাকায় ক্যাম্পগুলো অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিটি ক্যাম্পেই আস্তানা গেড়েছে অপরাধীরা। চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত সংকীর্ণ স্থানে তারা বাস করে। আর চরম দারিদ্র্য তো আছেই। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবহার করছে দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় রাজনৈতিক

নেতারা বিহারিদের ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছেন। আর এমন পরিবেশে থেকেই বড় হয়ে ওঠা বিহারি তরুণ-যুবকরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। প্রতিটি বিহারি ক্যাম্পেই মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনাবেচা হচ্ছে। প্রশাসনের সবাই বিষয়টি জানে। তারা এ জন্য প্রতি মাসে পাচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। তাদের হয়ে চাঁদা তোলার জন্য সোর্সও নিয়োগ দেওয়া আছে ক্যাম্পগুলোতে। পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

জানা গেছে, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে দুই গডফাদার। ক্যাম্পে সব ধরনের মাদক পাওয়া গেলেও এখন মূলত ইয়াবা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। জেনেভা ক্যাম্পের বোবা বিরিয়ানির গলি এবং পাকা ক্যাম্পের ‘এ’ ও ‘বি’ ব্লক এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের চলাফেরা বেশি। ক্যাম্পে মাদকের খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০। সন্ধ্যার পর প্রকাশ্যেই মাদক বিক্রি হয়। বলা চলে ফেরি করে বিক্রি হয় ইয়াবা-গাঁজা। মোহাম্মপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ১০-১২ বছরের শিশুরাও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তাদের দিয়ে খুচরা বিক্রির কাজ করানো হচ্ছে। তরুণের পাশাপাশি নারীরাও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে মিরপুরের ক্যাম্পগুলোতে মাদক ব্যবসা কিছুটা কম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুর ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা কোথায় যাব? আমাদের তো সব লোকই ব্যবহার করে। শুনলেও দোষ, না শুনলেও দোষ। পাঁচ বছর আগে মিরপুরের কালশীতে আমাদের শিশুসহ ১০ জনকে পুড়িয়ে মারছে। এর তো কোনো বিচার হলো না। রাজনীতিবিদরাও আমাদের ব্যবহার করে। প্রশাসনের লোকরাও হয়রানি করে। কিছু হলেই রুপিয়া চায়। না দিলে ধরে লিয়ে যায়।’ গত মার্চে মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ সময় ক্যাম্পের প্রায় ১৩টি স্পটে অভিযান চালানো হয়। র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প ঢাকা শহরের চিহ্নিত মাদক স্পট। দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করে বিহারি ক্যাম্পে আনা হয়। এরপর সেখান থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদক সরবরাহ করা হয়। বিহারি ক্যাম্প নিয়ে র‌্যাব সোচ্চার রয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছর মার্চে বিহারি ক্যাম্পে বড় অভিযান চালানো হয়। সেখানে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। মাঝেমধ্যে অভিযানও চালানো হচ্ছে। বিহারি ক্যাম্পে মাদকের বিস্তার বিষয়ে জানতে চাইলে বিহারিদের সংগঠন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট (ইউএসপিওয়াইআরএম) সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে  বলেন, ‘আমি র‌্যাব মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই ক্যাম্পে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য। এই অভিযানের ফলে ক্যাম্পে যে মাদকের বিস্তার ঘটেছিল তা কমছে।’ তিনি দ্রুত মিরপুর ক্যাম্পের আশপাশ এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

জানা গেছে, বিহারিদের মধ্যে শিক্ষার হার কম থাকায় তারা সম্মানজনক পেশা ও চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। রাজধানীর ক্যাম্পগুলোতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। কাজের সুযোগ না থাকায় জেনেভা ক্যাম্পের তরুণ ও উঠতি বয়সী ছেলেরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। পরিবারের স্বামী-স্ত্রী কারচুপির কাজ করলেও এর পাশাপাশি কোনো কোনো পুরুষ মাদক ব্যবসায় জড়িত। আর মাদকের ব্যবসা করতে গিয়ে পুরুষ মানুষটা কোনোভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়লে তখন তার স্ত্রী মাদকের ব্যবসা পরিচালনা করেন। জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় চার হাজারের মতো ছোট খুপরিঘরে একেকটি পরিবারের পাঁচ থেকে আটজন বাস করে। একটি কক্ষে ওপরে-নিচে গাদাগাদি করে সবাই থাকায় তাদের অত্যন্ত অমানবিকভাবে জীবন কাটাতে হচ্ছে। সম্প্রতি এই ক্যাম্পে তোতা মিয়া নামের এক কারচুপি ব্যবসায়ীর ঘরে গিয়ে দেখা যায়, চৌকির ওপর-নিচে গাদাগাদি করে পরিবারের সদস্যরা থাকছেন। কোনো পরিবারে সদস্যসংখ্যা আরও বেশি হলে কেউ কেউ ছাদে ও ঘরের বাইরে খোলা স্থানে থাকেন। ক্যাম্পে সরু গলিগুলোর মধ্য দিয়ে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই এসব ঘরে পানি ঢুকে তলিয়ে যায়। অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধময় এই ক্যাম্পে একসঙ্গে গাদাগাদি করে বসবাস করায় বিহারিদের সংক্রামক ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বেশ কিছু এনজিও ক্যাম্পে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও এই সেবা পর্যাপ্ত নয়। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্য বেশ কিছু টয়লেট বানানো হলেও মোট ব্যবহারকারীর তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। অনেক সময় টয়লেট সারতে বাসিন্দাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এর আগে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র এসব বিহারি ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দাকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আদর্শগত দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভাষাগত ভিন্নতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র খুব সহজেই এই বিহারি জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নেতিবাচক মানসিকতাকে উসকে দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অনেক বিহারিকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়েও তাদের ভূমিকা ছিল। আবার সরকারদলীয় স্থানীয় এমপির সমর্থকরা ব্যাপক গণসংযোগের মাধ্যমে এদের দলে ভেড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত।

সর্বশেষ খবর