রাজধানী ঢাকা আর নিতে পারছে না অপরিকল্পিত নগরায়ণের ভার। আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা, হাসপাতাল-ক্লিনিক, শপিং মল থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। সুয়ারেজ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব সেবা প্রদানে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। শহরজুড়ে ঝুলছে ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগের তার। কোথাও বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের তার। পর্যাপ্ত পার্কিং ছাড়া গড়ে উঠছে শপিং কমপ্লেক্স, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানা প্রতিষ্ঠান। একই ভবনের নিচে শপিং কমপ্লেক্স, ওপরে বিশ্ববিদ্যালয়, আবার পাশেই চলছে গার্মেন্ট বা শিল্পকারখানা। কোনো কিছুতেই যেন নিয়ন্ত্রণ নেই কারও। নেই কোনো পরিকল্পনা। অপরিকল্পিত এ নগরায়ণ বেসামাল করে তুলেছে রাজধানী ঢাকাকে। বাড়িয়ে তুলেছে মানুষের ভোগান্তি। সত্তরের দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরুতেও ঢাকায় গার্মেন্ট ও শিল্পকারখানা ছিল। তখন জনসংখ্যা ছিল পরিমিত। ছিল না যানজট। কর্মসংস্থানের তাগিদে সময়ের সঙ্গে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ঢাকার জনসংখ্যা। সেই চাপ বাড়িয়েছে ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বড় বড় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অফিস-আদালত। একই সঙ্গে আবাসিক এলাকায় তৈরি হয়েছে একের পর এক গার্মেন্ট, শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের মতো আবাসিক এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায়। আবাসিকের পাশাপাশি চলছে শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস, গার্মেন্ট ও ছোট-মাঝারি কারখানা। পার্কিং না রেখে আবাসিক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল গড়ে ওঠায় দিনের অধিকাংশ সময় ওইসব এলাকায় লেগে থাকছে ভয়াবহ যানজট। অবিরাম হৈচৈ, রাস্তাজুড়ে পার্কিং, গভীর রাত পর্যন্ত ব্যাপক মানুষের আনাগোনা মিলিয়ে বেহাল অবস্থা আবাসিক এলাকাগুলোর। ফুটপাথ দখল হয়ে যাওয়ায় হাঁটার জায়গাও নেই। এদিকে শিল্প এলাকা তেজগাঁওয়ে গড়ে উঠছে সুউচ্চ ভবন। এখানে নিচতলায় চলছে কারখানা, ওপরতলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাসা হিসেবে। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা, কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কথা বলা হলেও তা মাঝপথে থমকে আছে। ফলে ঘটছে শিল্পকেন্দ্রিক দুর্ঘটনা। অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো ভয়াবহ রূপ নিয়ে জানমালের ক্ষতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসাবাড়িতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিলে খরচ তুলনামূলক কম পড়ে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল আবাসিক হিসেবে পরিশোধ করা যায়। এতে খরচ অর্ধেকে নেমে আসে। অন্যদিকে ভবন মালিকও বাসাবাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিলে বেশি ভাড়া পান। আইন পরিপন্থী হলেও রাজউকের দালাল সিন্ডিকেটকে হাত করে এ সুবিধা দুই পক্ষই ভোগ করে। সূত্রমতে, ঢাকায় ছোট-বড় ২ লক্ষাধিক শিল্পকারখানা থাকলেও প্রায় ৬০ হাজার গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে, ঠিক আবাসিক এলাকাতেই। নাগরিকদের জন্য এসব কারখানা শুধু বিড়ম্বনাই নয়, রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। পুরান ঢাকার অন্তত ১০টি থানা এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দার জীবন চলছে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে। বিক্ষুব্ধ বাসিন্দারা বলেছেন, বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদামগুলো দীর্ঘদিনেও অপসারণ করা গেল না! যে কোনো মুহূর্তে ফের নিমতলী, চকবাজার ট্র্যাজেডির মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এদিকে রাজউকের ঘোষিত আবাসিক এলাকাগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি আবাসিক ভবনেই দোকানপাট, শপিং মল ও বাণিজ্যিক অফিস গড়ে তোলা হয়েছে। গুটিকয় বাদে আর কোনো অফিস প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পার্কিং জোন নেই। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় রাজউক থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনাবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আসছেন। কেউ কেউ শিল্পকারখানা গড়ে তুলছেন। কোচিং সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন, ক্লিনিক, রেস্তোরাঁ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। আর এসব অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করে লাভবান হচ্ছেন রাজউকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর অবস্থা আরও নাজুক। অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ, অন্তত দেড় ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ২০টি ব্যাংক, শপিং মল, কমিউনিটি সেন্টার, শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে গুলশানে। এ ছাড়া চাইনিজ ও ফাস্ট ফুডের দোকান, ডিপার্টমেন্ট স্টোরসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান রয়েছে। গুলশান-বনানী থেকে উত্তরা মডেল টাউন পর্যন্ত আবাসিক এলাকার চেহারা মাত্র কয়েক বছরেই আমূল বদলে গেছে। শত শত বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ফলে সারা দিন আবাসিক এলাকাগুলো মানুষ আর যানবাহনে গিজগিজ করে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও রাস্তা দখল করে নির্মাণসামগ্রী রাখা, লোকালয়ে দিনরাত উচ্চ শব্দ করে মেশিনে ইট ভাঙা ও কংক্রিট মিক্সার চালানো মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘিœত করছে। এসব ধকল সয়েই বছরের পর বছর বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন রাজধানীর বাসিন্দারা।