বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে বন্ড জালিয়াতে নামি প্রতিষ্ঠান

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে বন্ড জালিয়াতে নামি প্রতিষ্ঠান

বন্ড সুবিধার (শুল্কমুক্ত) অপব্যবহার করে চট্টগ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক আমদানিকৃত পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছে। এতে সরকার একদিকে যেমন বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান। বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণসাপেক্ষে এপ্রিল ও মে মাসে চট্টগ্রামের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত ও পাঁচটির বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। এর পরও থামছে না ‘বন্ড সিন্ডিকেট’গুলোর

জালিয়াতির মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচার। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫টি বড় ধরনের বন্ড জালিয়াতির কারণে বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর বাইরে অপেক্ষাকৃত ছোট আরও অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। লাইসেন্স স্থগিত ও বাতিলের তালিকায় থাকা ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে অনেক। তালিকায় রয়েছে মেসার্স সামস ডি অ্যাপারেলস, মেসার্স কার্নিভাল ফ্যাশন, মেসার্স ট্রেড স্ক্যান লিমিটেড, মেসার্স বেনিলাক অ্যাপারেলস, ইমন অ্যাপারেলস, মেসার্স এএম সোয়েটার, মেসার্স সেঞ্চুরি, মেসার্স এনজা টেক্সটাইল, মেসার্স ইউনিটি ইন্ডাস্ট্রি (বিডি), মেসার্স ইফকো গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড, মিশন অ্যাপারেলস ইন্ডাস্ট্রি, নিড ড্রেসেস, মেসার্স লিংক এক্সেসরিজ, মেসার্স এসওএস আউটফিটার্স ও মেসার্স সীমা গার্মেন্টস। এ ছাড়া মেসার্স জেনফোর্ট শুজ (বিডি), মেসার্স ইউনেসকো ফেব্রিকস ওয়্যার, মেসার্স টিকেএম গার্মেন্টস লিমিটেড, মেসার্স গ্লোবাল স্পেশালাইজড, প্রাইম ফ্যাশন, গ্লোবাল অ্যাপারেলস, সাদমান ইন্টারন্যাশনাল, মোহাম্মদী ইন্টারন্যাশনাল, শ্যারন চৌধুরী অ্যাপারেলস, মেসার্স ডেনিম টেক্সটাইল, মেসার্স আল্লামা ফ্যাশন, মেসার্স আরএল ডেনিম, মেসার্স মার্ক ফ্যাশনওয়্যার, মেসার্স নূপুর অ্যাপারেলস, মেসার্স ভ্যানগার্ড ফ্যাশনের নাম উল্লেখযোগ্য। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, বন্ড সুবিধায় যেসব পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি করা হয়, এর প্রধান শর্ত হচ্ছে, দেশের কারখানায় তা ব্যবহৃত হয়ে পণ্য হিসেবে আবার রপ্তানি হবে বিদেশে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব পণ্য চলে যাচ্ছে খোলাবাজারে। বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের আরও কয়েকটি উদাহরণ হলো, অতিরিক্ত মূল্য দেখানো, মিথ্যা ঘোষণায় ভিন্ন পণ্য আমদানি ও অতিরিক্ত পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি। অনেক প্রতিষ্ঠানই আমদানিতে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করে থাকে। এ ছাড়া বিদেশে ভিন্ন নামে নিজেদের প্রতিষ্ঠান খুলে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই পণ্য আমদানি করা হয়। অনেকে আবার রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়েও অর্থ পাচার করে। অন্যদিকে রপ্তানির চেয়ে আমদানি করা হচ্ছে বেশি। এভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে দেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিচ্ছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে চট্টগ্রামেরও একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা বন্ড লাইসেন্স বানিয়ে টাকা পাচারের মতো এবং শুল্কমুক্ত পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির মতো অপরাধ করে যাচ্ছে। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে এনবিআর। প্রতি মাসে বিভিন্ন বন্ডেড প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে কোনো পণ্যের গরমিল থাকলে মামলা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। কিছু তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, যারা তৃতীয় পক্ষ হয়ে সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করে। আমরা সেই সব প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করে রেখেছি, যাতে তারা বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানি করতে না পারে। অন্যদিকে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ঠেকাতে বন্ড সুবিধা প্রদানের পুরো সিস্টেমটিকে অটোমেশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। তখন কেউ সহজে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না।’ জানা গেছে, চট্টগ্রামে বন্ড সুবিধা পেতে লাইসেন্স নিয়েছে সাড়ে চৌদ্দ শরও বেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আট শতাধিক প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাকশিল্পের, বাকি প্রতিষ্ঠান এক্সেসরিজের। দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে সরকার প্রণোদনা হিসেবে এই বন্ড সুবিধা দিয়ে আসছে। মূলত বন্ড সুবিধার মাধ্যমে কম শুল্ক কিংবা শুল্ক ছাড়াই এসব পণ্য আমদানির সুযোগ পান দেশীয় উদ্যোক্তারা। গুটিকয় প্রতিষ্ঠান এসব বন্ড সুবিধার সদ্ব্যবহার করলেও বেশির ভাগই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ গার্মেন্ট এক্সেসরিজ প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহ-সভাপতি খন্দকার লতিফুর রহমান আজিম বলেন, বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত পণ্য এনে এর একটি অংশ খোলাবাজারে বিক্রির ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটি দেশীয় শিল্প ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা অসাধুদের জন্য দাঁড়াতে পারছেন না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য ও কাঁচামাল এনে বাজারে তা বিক্রি করে দিয়ে রাতারাতি অনেকেই লাখপতি-কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। এতে ব্যবসায়িক পরিবেশ বিনষ্ট এবং ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর