সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

আতঙ্ক নতুন জঙ্গি

অনলাইনকেন্দ্রিক তৎপরতা, চোরাগোপ্তা ও ‘লোন উলফ’ হামলার শঙ্কা

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার

আতঙ্ক নতুন জঙ্গি

গুলশানে হলি আর্টিজান রেঁস্তোরায় জঙ্গিদের দমনে সেনাকমান্ডো অভিযান চালানো হয় -ফাইল ফটো

তিন বছর আগে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতিতে থাকা ঢাকার কূটনীতিকপাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন সেই জঙ্গি হামলাকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছে, হামলার ওই ঘটনা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট করে তোলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বুঝতে পারে, এই জঙ্গিরা কী চায়? কী তাদের উদ্দেশ্য? কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কিংবা কারা তাদের অর্থায়ন করছে। কেবল মাদ্রাসাপড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে না, নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে-এ তথ্যটিও জানা যায় এ হামলার ঘটনায়। এসব বিষয় সামনে রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে থাকে সরকার। এ সময়ের মধ্যে র‌্যাব-পুলিশের জঙ্গিবিরোধী ২৬০টি অভিযানে নিহত হয় ৮৮ জন। গ্রেফতার হয়েছে ১ হাজার ২২০ জন। এরপরও জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না দেশ। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এখন নতুন জঙ্গিরা। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসপন্থি এই জঙ্গিরা নানাভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অনলাইনকেন্দ্রিক তৎপরতা গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে। চোরাগোপ্তা হামলা ও লোন উলফ হামলার আশঙ্কাও রয়েছে। মাঝে-মধ্যে নিখোঁজের সংবাদ উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। হলি আর্টিজানে ভয়ঙ্কর সেই হামলার তিন বছরের মাথায় নতুন মাত্রায় হুমকি হয়ে উঠেছে আইএসপন্থি জঙ্গিরা। শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার পর ঢাকায় পুলিশের ওপর এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে দুটি বোমা হামলা এবং আইএসের দায় স্বীকারের ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে এখানকার জঙ্গিগোষ্ঠী। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের মতে, যে কোনো আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক বা জাতিগত ঘটনার প্রভাব পড়ে জঙ্গিদের ওপর। নিউজিল্যান্ডে হামলার পর বাংলাদেশে ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিদের ভিতরে একটা আলোড়ন দিখেছি। এর পরপরই শ্রীলঙ্কায় হামলাও তাদের বড় অনুপ্রেরণা ছিল। তাদের ইনটেনশন থাকলেও ক্যাপাসিটি বিপর্যস্ত করে দেওয়ায় তারা কোনো ধরনের নাশকতায় সক্ষম হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে গেছে। নেতৃত্ব পর্যায়ে ধারাবাহিক সব নেতাই হয়তো কোনো না কোনো অভিযানে নিহত হয়েছেন, নয়তো গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন। জঙ্গিদের প্রচেষ্টা থাকলেও বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই।

জানা গেছে, এ দেশে আইএস মতাদর্শীর জঙ্গিগোষ্ঠী, যাদের পুলিশ ‘নব্য জেএমবি’ বলে থাকে, তারা প্রায় তিন বছর ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে দুটি হামলার মধ্য দিয়ে নিজেদের জানান দেয়। এবারের ঈদুল ফিতরের সময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ধরনের হামলা হতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। এ নিয়ে ঢাকার কূটনৈতিক মহলেও উদ্বেগের সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়। পরে ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঈদুল ফিতরের জামাতে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় কোনো অঘটন ছাড়াই সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও অনলাইনে তৎপরতা এবং গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সবকটি জঙ্গিগোষ্ঠীরই সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে তাদের পুনরায় সংগঠিত হওয়া ও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টাও রয়েছে।

এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জঙ্গিবাদ আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছি এটা ঠিক, তবে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি আর যাতে কেউ নতুন করে রেডিক্যালাইজড না হয়। একই সঙ্গে জামিনে বের হয়ে জঙ্গিরা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। জঙ্গিবাদ রুখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে র‌্যাব। বিগত বছরগুলোতেও আমাদের ঈর্ষণীয় সাফল্য আছে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।

নিখোঁজ সংবাদে উদ্বেগ : জঙ্গিবাদে জড়িত হয়ে দেশ ছেড়েছেন এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা পুলিশের তরফ থেকে ২০ এর বেশি নয় বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা ৫০ এর বেশি। এদের অনেকে আবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক। সিটিটিসি সূত্রের দাবি, এদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন। তবে এখনো যারা ইরাক কিংবা সিরিয়ায় আছে, তারা যাতে কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ না করতে পারে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের নামের তালিকা ইমিগ্রেশন পয়েন্টগুলোতে দেওয়া আছে। তাদের ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশও এ বিষয়ে খুব সতর্ক রয়েছে।

জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বিশেষায়িত ইউনিট : হলি আর্টিজান পরবর্তী জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তিনটি বিশেষায়িত্ব ইউনিট গঠন করা হলেও আতঙ্ক কাটেনি জঙ্গিবাদ নিয়ে। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। পুলিশ সদর দফতরের অধীনে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয়েছে আরেকটি বিশেষায়িত ইউনিট এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অধীনে গঠন করা হয়েছে সাইবার পুলিশ সেন্টার।

পুলিশের সংবাদ সম্মেলন : গতকাল বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিবাদ একটি মতবাদ। জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও জঙ্গিবাদ এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। তাই তারা অনুকূল পরিবেশ পেলে ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করে তাদের সক্ষমতার ওপর। হলি আর্টিজান হামলার পরবর্তী সময়ে আমরা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছি। তাই অতীতেও তাদের কোনো অপতৎপরতা সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও তারা সক্ষম হবে না। ঝুঁকির মাত্রা খুব বেশি না থাকলেও আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন থাকলে জঙ্গিরা কখনই সফল হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর