মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্নীতি-চোরাচালানে জড়িত বন্ডের ২৯ কোম্পানি

রুহুল আমিন রাসেল

বন্ড লুটেরা হিসেবে ৬৭ মাফিয়া চিহ্নিত হওয়ার পর এবার ২৯টি লুটেরা কোম্পানিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা বছরের পর বছর সরকারের বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। দেশীয় কোম্পানির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তারাই বিদেশি পণ্যের একচেটিয়া বাজার গড়ে তুলেছে। এতে একদিকে যেমন বেশুমার রাজস্ব ফাঁকি চলছে, অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতায় ফেলে দেশীয় শিল্প-কারখানাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বন্ড সুবিধা ব্যবহার করেই চিহ্নিত কোম্পানিগুলো সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকছে। ধ্বংস করছে দেশের শিল্প-বাণিজ্য খাতকে। তবু বরাবরই তারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বন্ডেড সুবিধাপ্রাপ্ত ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও চোরাচালানে জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বন্ড মাফিয়াদের সহায়তায় এসব কোম্পানিও রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের মচ্ছবে মেতে ওঠে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, লুটেরা কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগই ভুঁইফোড়। এ ছাড়া বেশ কয়েকটির কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা কার কার সহায়তায় কীভাবে বন্ড সুবিধা জুটিয়ে নিয়েছিল সে ব্যাপারে কোনো বিবরণ প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টিকারী চক্রকে এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। শাস্তির আওতায় আনাও সম্ভব হচ্ছে না তাদের। ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি, চোরাচালানে জড়িত বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহারকারী ২৯টি কোম্পানিকে রাজস্ব আয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব দুই-নম্বরি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই কোম্পানিগুলোয় নিরীক্ষা করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহারের তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। কিছু কোম্পানির অস্তিত্ব নেই, আবার বন্ধও পাওয়া গেছে। আরও কিছু কোম্পানির নিরীক্ষা চলছে। এসব ভুঁইফোড় কোম্পানি শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানি করে কালোবাজারে বিক্রি করছে। এই ২৯টি বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধাপ্রাপ্ত কোম্পানিকে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে একটি তালিকা করেছে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট (সিভিসি)। সংস্থাটি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরের বন্ডেড প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড এ এন্টারপ্রাইজ এবং রাজধানীর লালবাগ এলাকার এ অ্যান্ড এ এক্সেসরিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ অ্যান্ড এ এন্টারপ্রাইজে কোনো আমদানি-রপ্তানির তথ্য নেই। আর এ অ্যান্ড এ এক্সেসরিজ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকার ক্যাপিটাল মেশিনারিজসহ পণ্যসামগ্রী বন্ড সুবিধায় আমদানি করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তাই এই প্রতিষ্ঠানেরও বন্ড লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে সাভারের ৫এফ অ্যাপারেলস। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকার নিট  ফেব্রিকস আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এ ছাড়া ইউডি-বহির্ভূত প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা এবং স্থানীয়ভাবে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার পণ্য ক্রয় করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে ৫এফ অ্যাপারেলস। ইউডি-বহির্ভূত পণ্য আমদানি ও স্থানীয়ভাবে পণ্য সংগ্রহ করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। মিরপুরের ৪ইউ ক্লথিং লিমিটেডের নিরীক্ষায় অনিয়ম পাওয়া গেছে, যা বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহারের শামিল। দুটি প্রতিষ্ঠান একই ভবন ব্যবহার করছে। দুই প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও তৈরি পোশাক একই সঙ্গে গুদামজাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আশুলিয়া সাভারের বন্ডেড প্রতিষ্ঠান ফোরএস পার্ক স্টাইল প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার কেজি কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে। এ প্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ প্রায় দেড় লাখ টাকা, নারায়ণগঞ্জের এবি সোয়েটারস, সাভারের এবি এক্সেসরিজ, এএমসিএস টেক্সটাইল, উত্তরার এবিএম অ্যাপারেলস, গাজীপুরের এএফএম সোয়েটারস, হেমায়েতপুরের এজেআই অ্যাপারেলস ইন্ডাস্ট্রিজ, টঙ্গীর এজি ড্রেসেস, মিরপুরের একেজে ফ্যাশন, সাভারের একেএইচ স্টিচ আর্ট, একেএম নিটওয়্যার, শ্যামপুর এলাকার এ ওয়ান ড্রেস মেকারস, গাজীপুরের এবিজি সোয়েটারস এবং নারায়ণগঞ্জের এ অ্যান্ড এইচ এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পুরো বন্ডিং কার্যক্রম খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। গাজীপুরের এ অ্যান্ড এ ফ্যাশন, এ অ্যান্ড এ ট্রাউজার, সাভারের এ ওয়ান (বিডি), এজে সুপার গার্মেন্টস, এ প্লাস সোয়েটারস লিমিটেডের নিরীক্ষায় রাজস্ব ফাঁকি পাওয়া যায়নি। নিরীক্ষা চলমান রয়েছে সাভারের থ্রি-এ ফ্যাশন, নারায়ণগঞ্জের এ ওয়ান পোলার, নারায়ণগঞ্জের এ কে ফ্যাশন, গাজীপুরের এএমসি সোয়েটার এবং সাভারের একে এক্সেসরিজ প্রাইভেট লিমিটেডের। এসব প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদন শিগগিরই দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্ডের অপব্যবহারকারীদের মুখোশ দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হবে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বন্ডেড সুবিধা অপব্যবহারকারী ৬০ থেকে ৭০টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছি। বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কারখানায় কাস্টমসের অভিযান চলছে।’

সর্বশেষ খবর