বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

সীতাকুণ্ডে উপকূলীয় পরিবেশ ধ্বংস করে শিপইয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

সীতাকুণ্ডে উপকূলীয় পরিবেশ ধ্বংস করে শিপইয়ার্ড নির্মাণের উদ্যোগ

শিপইয়ার্ড নির্মাণ হলে এই উপকূলীয় গাছপালা বসতভিটাসহ পরিবেশ ধ্বংস হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বোয়ালিয়াকূল এলাকায় শিপইয়ার্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে সেখানে একদিকে উপকূলীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হবে, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়বে প্রায় ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত সুদীর্ঘ বেড়িবাঁধ। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সীতাকুন্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সাগর উপকূলীয় বোয়ালিয়া মৌজার মানুষ দীর্ঘকাল ধরে নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বসবাস করে আসছে। দুই দশক ধরে ভাঙা পড়েছিল এই গ্রামের রক্ষাকবচ উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। এ ছাড়া নির্বিচারে উপকূলীয় বৃক্ষ নিধনে অসহায় হয়ে এই মানুষগুলো আতঙ্কে বিনিদ্র রাতযাপন করছিল। তবে তাদের দীর্ঘদিনের দাবির কথা মাথায় রেখে সরকার সম্প্রতি ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করেছে। এতে এলাকার মানুষ যখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই এই গ্রামের সাগর উপকূলকে জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়ার একটি খবর ছড়িয়ে পড়ায় আবারও অশান্তি নেমে এসেছে বাসিন্দাদের জীবনে। কারণ এখানে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হলে একদিকে সবুজ বেষ্টনী উজাড় হয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে দীর্ঘ দেনদরবারে পাওয়া বাঁধটি আবারও চরম হুমকির মুখে পড়বে। এলাকাবাসী জানান, ষাটের দশকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট সাগর উপকূলে প্রথম জাহাজভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তনের পর গত অর্ধশতাব্দীতে তা কুমিরাবাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী আকিলপুর পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিমি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ঠিক পরের অংশ বাঁশবাড়িয়ার বোয়ালিয়া মৌজার অন্তর্গত। এই অংশে প্রচুর উপকূলীয় গাছপালা ও বেশকিছু বাড়িঘর রয়েছে। কিন্তু গত দুই দশক বেড়িবাঁধটি ভেঙে সাগরে বিলীন থাকায় জানমাল হুমকিতে পড়েছিল। ফলে সরকার প্রায় ৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে জানমাল রক্ষায় সোয়া দুই কিমি দীর্ঘ বাঁধ সংস্কার করে। এতে জনমনে স্বস্তি ফিরে এলেও সম্প্রতি এই স্থানেও কিছু কুচক্রী মহল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি আমলে নিয়ে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে- এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বোয়ালিয়াকূলে একেবারে সাগরের কাছেই অনেকগুলো বসতি আছে। এখানে প্রচুর উপকূলীয় গাছপালাও আছে, যা স্থানীয় মানুষকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে আসছে। বেড়িবাঁধটি ভেঙে বিলীন হয়েছিল। শুধু এলাকার মানুষকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে আমরা বার বার বাঁধ সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলাম। এমপি দিদারুল আলম পানিসম্পদ মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক যোগাযোগ করে ৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়ে আমাদের দাবি পূরণ করেন। বোয়ালিয়া মৌজার জেএল নম্বর ৪০ এর জায়গা রক্ষায় সবাই সচেষ্ট হলেও এখন শুনছি কেউ কেউ সেখানে শিপইয়ার্ড করতে চান। আবার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য দফতর নাকি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় সবাই উদ্বিগ্ন। এরকম হলে অনেকেই তাদের বসতভিটা হারাবেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর। এখানে যেসব কড়ই, গেওয়া, আম, জাম, নিম, নারিকেল, সুপারি গাছ আছে তা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে আসছে। এখন যদি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হয় তবে পুরো পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি পড়ে জানমাল চরম হুমকিতে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘সীতাকুন্ডের উত্তর সোনাইছড়ি মৌজা পর্যন্ত শিপব্রেকিং জোন ঘোষিত আছে। এরপর থেকে বোয়ালিয়া মৌজা। এই মৌজায় শিপব্রেকিং ইয়ার্ড করার কোনো সুযোগ নেই। তবু কেউ কেউ ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এখানে ইয়ার্ড করতে চান বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবা দরকার। ব্যক্তিস্বার্থে কোনো কর্মকর্তা যেন ব্যবহার না হন তাও দেখা জরুরি।’ একই কথা বলেন বোয়ালিয়াকূলের বাসিন্দা মো. আরিফ হোসেন, সালাউদ্দিন ও রাকিব। তারাও প্রায় অভিন্ন মতামত রেখে বোয়ালিয়াকূলে যেন আর কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ড না হয় সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপব্রেকিং অ্যান্ড শিপ রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নিউ পতেঙ্গা থেকে কুমিরা পর্যন্ত আমাদের শিপব্রেকিং জোন। বাঁশবাড়িয়ার কোনো অংশ এই জোনের অন্তর্গত বলে আমার জানা নেই। যেখানে শিপব্রেকিং জোন নয় সেখানে শিপইয়ার্ডও হওয়ার কথা নয়। কেউ করতে চাইলেও তা সম্ভব নয়। এভাবে যেখানে-সেখানে কেউ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তুললে তো হবে না। একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে থাকতে হবে।’ এদিকে প্রক্রিয়া চললেও বোয়ালিয়া মৌজা শিপব্রেকিং জোনের মধ্যে নয় বলে জানিয়েছেন সীতাকুন্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ মো. মাহবুবুল হক। তিনি বলেন, উত্তর সলিমপুর থেকে উত্তর সোনাইছড়ি মৌজা পর্যন্ত শিপব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনের জোন রয়েছে। এর পরে শিপব্রেকিং জোন করার সুযোগ কাগজে-কলমে নেই। আর এ-সংক্রান্ত কোনো আবেদন পাইনি।’ নিয়মের বাইরে কিছুই হবে না বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর