বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

নয়ন বন্ড নিহত, বাকিরা কোথায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

নয়ন বন্ড নিহত, বাকিরা কোথায়

বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয়ন বন্ড

বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যার প্রধান খুনি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। গতকাল ভোর  সোয়া ৪টার দিকে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকায় তাকে গ্রেফতারের সময় তুমুল বন্দুকযুদ্ধের পর নয়ন বন্ডের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। রিফাত শরীফ হত্যার প্রধান আসামি নিহত হলেও এজাহারভুক্ত প্রধান অপর দুই আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ছোট ভাই রিশান ফরাজীসহ সাতজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা এখন কোথায়- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারের সময় বন্দুকযুদ্ধের পর নয়নের লাশ পাওয়া গেলেও পালিয়ে গেছে তার সঙ্গীরা। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে থানায় আটটি মামলা রয়েছে। 

পুলিশ সূত্র জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারে বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ।  পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নয়ন বন্ড তার দলবল নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। আধা ঘণ্টা স্থায়ী এ বন্দুকযুদ্ধের পর অস্ত্রধারীরা পিছু হটতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ পুরো এলাকায় তল্লাশি চালায়। এ সময় ঝোপের আড়ালে পড়ে থাকা নয়ন বন্ডের গুলিবিদ্ধ লাশের সন্ধান পায় পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলি, দুটি শর্টগানের গুলির খোসা এবং তিনটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। তারা হলেন- অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল শাজাহান হোসেন, এসআই মনিরুজ্জামান, এসআই হাবিবুর রহমান ও কনস্টেবল হাবিব। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পূর্ব বুড়িরচর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল বারেক ও কবির হোসেনের তথ্য মতে, ভোর রাত সোয়া ৪টার দিকে তারা বেশ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পান। এতে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। ভোর ৫টার দিকে তারা খলিল মাস্টারের বাড়ির দরজার সামনে বাঁধের ঢালে এক যুবকের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশ তার লাশ ঘিরে রেখেছিল। বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড পালিয়ে ওই এলাকায় অবস্থান করছেন এমন তথ্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে অভিযান চালায়। পুলিশের অবস্থান টের পেয়ে নয়ন ও তার সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছুড়লে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এটা নয়ন বন্ডের লাশ বলে স্থানীয় লোকজন শনাক্ত করে। গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নি হামলাকারীদের বাধা দিয়েও স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি। রিফাতকে কুপিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে হামলাকারীরা। তারা চেহারা লুকানোরও কোনো চেষ্টা করেনি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। জনবহুল এলাকায় এমন নৃশংস হামলার ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভের ঝড় ওঠে।

রিফাত হত্যার পর দিন ২৭ জুন ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন রিফাতের বাবা মো. আ. হালিম দুলাল শরীফ। আসামিরা হলো- সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) (২৫), মো. রিফাত ফরাজী (২৩), মো. রিশান ফরাজী (২০), চন্দন (২১), মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন (১৯), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রায়হান (১৯), মো. হাসান (১৯), রিফাত (২০), অলি (২২) ও টিকটক হৃদয় (২১)। বাকি পাঁচ থেকে ছয়জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এ মামলায় এ পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে চন্দন (২১), মো. হাসান (১৯), অলিউল্লাহ (২২) টিকটক হৃদয় (২১) এজাহারভুক্ত আসামি। ঘটনার পরের দিন সকালে চন্দনকে, সন্ধ্যায় মো. হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। রবিবার বরগুনা থেকে অলিউল্লাকে (২২) এবং ঢাকা থেকে টিকটক হৃদয়কে (২১) গ্রেফতার করা হয়। অন্য পাঁচজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরা হলেন- নাজমুল ইসলাম (১৮), সাগর (১৯), তানভীর (২২), কামরুল হাসান ওরফে সাইমুন (২১)। অপর একজনের নাম পুলিশ প্রকাশ করেনি। এর আগে এই মামলায় গ্রেফতার দুই আসামি অলিউল্লাহ ওরফে অলি ও তানভীর হোসেন ১৬৪ ধারায় বরগুনার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অলিউল্লাহ রিফাত হত্যা মামলার ১১ নম্বর আসামি। তাকে রবিবার গ্রেফতার করা হয়।

অপর আসামি তানভীর সন্দেহভাজন আসামি। সে মূল আসামি নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী দল ০০৭-এর সক্রিয় সদস্য। তবে মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও এজাহারভুক্তদের মধ্যে ৭ জন এখনো পলাতক।

কে এই নয়ন বন্ড

বরগুনা পৌর শহরের ডিকেপি রোড এলাকার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড)। শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি সড়ক, কেজি স্কুল ও ধানসিঁড়ি সড়কে মূলত নয়নের বিচরণ ছিল। ছিনতাই, ছাত্রদের মোবাইল ফোন জিম্মি করে টাকা আদায়, ছোটখাটো মারধর থেকে তার অপরাধপ্রবণতা শুরু হলেও ২০১৭ সালে পুলিশি অভিযানে নয়নের কলেজ রোডের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ তাকে আটক করে পুলিশ। এর পরই নয়ন নামটি লাইমলাইটে চলে আসে। ওই মামলায় জামিনে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। এরপর সে নিয়মিত মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যায় এবং রিফাত ফরাজীকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করে। ওই গ্রুপে নয়নের সহযোগী হিসেবে বরগুনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি সড়কের দুলাল ফরাজীর দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও তার ছোটভাই রিশান ফরাজী কাজ করত।

মূল নাম সাব্বির আহমেদ নয়ন হলেও কর্মকান্ডের জন্য রহস্য উপন্যাসের চরিত্র জেমস বন্ডের নাম নিজের নামে জুড়ে দেয় নয়ন। ফলে সহযোগীরা তাকে ডাকা শুরু করে ‘নয়ন বন্ড’ নামে। রিফাত ফরাজী ও অন্যদের সহযোগিতায় ধানসিঁড়ি সড়ক থেকে শুরু করে শহরজুড়ে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল নয়ন। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সে।

নিহত রিফাতের আত্মীয় ও কয়েকজন বন্ধু জানান, এক বছর আগে বাকিতে সদাই বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় বিকেবি সড়কের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নয়া মিয়ার পা ভেঙে দেয় নয়ন। এর কিছুদিন পর বাসা থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ইয়াবা ও দেশীয় ধারালো অস্ত্রসহ নয়নকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এই মামলায় কিছুদিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক এমপি এবং বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে ছাত্রলীগ নামধারী রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীদের সঙ্গে চলাফেরা করায় কাউকেই পরোয়া করছিল না নয়ন।

সর্বশেষ খবর