শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজধানীতে একে-২২ আতঙ্ক

হলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল এই অস্ত্র, নানা কৌশলে প্রবেশ করছে অস্ত্রের চালান

সাখাওয়াত কাওসার

রাজধানীতে একে-২২ আতঙ্ক

হঠাৎ করে দেশে মিলছে একে-২২ নামের স্বয়ংক্রিয় ভারি অস্ত্র। রাজধানীতেও মিলছে এ অস্ত্র। এতদিন ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কাছ থেকে এ অস্ত্র উদ্ধার হলেও এখন জামায়াত-শিবির সদস্যদের কাছ থেকেও এ ধরনের অস্ত্র মিলছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এ অস্ত্র ব্যবহারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?

কেউ কেউ বলছেন, একে-২২ সংগ্রহকারী ও সরবরাহকারীরা একই সুতায় গাঁথা। আদর্শগত দিক থেকে তারা এক ও অভিন্ন। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ থেকে পরবর্তীতে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত একে-২২ অস্ত্রের ব্যবহারকারী ছিল জঙ্গিরা। এবার জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে এ ধরনের ভারি অস্ত্রের সন্ধান মেলায় ভাবিয়ে তুলেছে র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় ব্যবহৃত একে-২২ কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে এখনো সুস্পষ্ট তথ্য না পেলেও তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছিলেন, চট্টগ্রাম এলাকা থেকে ওই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল জঙ্গিরা। জানা গেছে, গত রবিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের আর্মস এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা রাজধানীর ওয়ারী রাজধানী মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় একে-২২ রাইফেল ও ৩০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। এ সময় সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় কামাল হোসেন (৩৫) ও সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল (৩০) নামের দুজনকে। তবে সেখানে উপস্থিত থাকা হাসিবুর রহমান, কাজী গোলাম কিবরিয়া, বাবুল উদ্দীন ও সাদেক আহম্মেদ (৩২) ওরফে সাদিক নামের চারজন কৌশলে পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ছয় মাসে আরও দুটি একে-২২-এর চালান গ্রহণ করেছে একই চক্র। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানান, অস্ত্র সরবরাহ ও গ্রহণকারী দুই পক্ষের লোকজনই জামায়াতের সক্রিয় সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া কাজী গোলাম কিবরিয়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, হাসিবুর দুর্ধর্ষ জামায়াত নেতা। ২০০২ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বোমা নিক্ষেপ করতে গিয়ে হাসিবের দুই হাতের আঙ্গুল উড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে হাসিবের নাম হয় বোমা হাসিব। ২০১৭ সালে তিনি র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। হাসিব এক সময় জামায়াত নেতা আবু তাহেরের দেহরক্ষী ছিলেন। পলাতক বাবুল চট্টগ্রামের শিবিরের সাবেক ক্যাডার। বাড়ি চট্টগ্রামের ডবলমুরিংয়ে। গ্রেফতার কামাল হাসিবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পেশায় ট্রাকচালক রুবেলও একই চক্রের সদস্য। চট্টগ্রামের চকবাজারের বাসিন্দা সাদেক যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। সিটিটিসির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৬ সালের পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিরা এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের ক্রেতা ছিল জামায়াত নেতা। আমরা তাকে খুঁজছি। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই হয়তো আরও তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’ দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঠিক এক মাস আগে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে দুটি একে-২২ রাইফেলসহ গ্রেফতার হয়েছিল দুজন। ওই সময় তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, ‘এর আগে আরও ৭ থেকে ৮টি ভারি অস্ত্র তারা হাতবদল করেছে।’ এরপর সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ হামলায়। পরবর্তীতে কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পলাতক শীর্ষ জঙ্গি তামিমের কাছ থেকে নারায়ণগঞ্জে উদ্ধার হয় একটি একে-২২। গত বছর রংপুরে এবং বগুড়ায় জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় আরও দুটি একে-২২। অস্ত্রের গায়ে ‘মেইড ইন চায়না’ লেখা থাকলেও অস্ত্র নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করা একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, রাশিয়ায় একে-২২ অস্ত্র উৎপাদন হতো। কাজেই এটি কোনোভাবেই চীনে তৈরি হওয়ার কথা নয়। তাদের ধারণা, এ অস্ত্র পাকিস্তান, থাইল্যান্ড কিংবা মিয়ানমারের আন্ডারগ্রাউন্ডে তৈরি হয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে দেশে ঢুকেছে। হলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত একে-২২ দিয়ে ব্রাশফায়ার সম্ভব ছিল না। তবে এখনকার একে-২২ দিয়ে ব্রাশফায়ারও সম্ভব। এক সময় বিভিন্ন দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য এ অস্ত্র ব্যবহৃত হতো। গোয়েন্দাদের ধারণা, কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নানা প্রলোভনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করছে একটি মহল। তাদের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার পাশাপাশি এ ধরনের ভারি অস্ত্র ঢুকানো হচ্ছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আবার চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে এসব ভারি অস্ত্র ঢোকার সম্ভাবনা রয়েছে। র‌্যাব-৭ গত বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কয়েক দফায় ভারি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। সিটিটিসির আর্মস এনফোর্সমেন্টের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা মাত্র একটি রুট অনুসরণ করতে গিয়ে ছয় মাসের ব্যবধানে আরও দুটি অস্ত্রের চালান সন্ত্রাসীদের হাতে যাওয়ার তথ্য পেয়েছি। যার একটি ধরা পড়েছে এবং এর সঙ্গে জামায়াতের বিভিন্ন এলাকার নেতা-কর্মীরা জড়িত। দেশের অন্য রুটগুলো দিয়েও এ ধরনের ভারি অস্ত্র তাদের কাছে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর