শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

খালেদাকে কি ভুলে গেছে বিএনপি!

তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন, হতাশা

মাহমুদ আজহার

খালেদাকে কি ভুলে গেছে বিএনপি!

‘আমাদের নেতা-কর্মীদের চরম ব্যর্থতা হলো, আমরা রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনতে পারিনি।’ কথাগুলো বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের। তার মতে, ‘আদালতের দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে হলে রাজপথকেই ঠিকানা করা উচিত।’ এ মনোভাব শুধু অনিন্দ্য ইসলাম অমিতেরই নয়, বিএনপির তৃণমূলের প্রায় সব নেতা-কর্মীরই। তাদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া হয়েছিল বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। কিন্তু সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আন্দোলনের কিছুই হয়নি। সম্প্রতি পরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বেগম জিয়ার মুক্তিতে ‘প্যাকেজ’ কর্মসূচি দেওয়া হবে। কিন্তু দুই সপ্তাহেও কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি দলটি। ৭২-ঊর্ধ্ব বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৫১১ দিন কারাবাসে রয়েছেন। নানা রোগ-শোকে আক্রান্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন।

সূত্রমতে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে কোনো চিকিৎসায়ই সুফল পাচ্ছেন না বিএনপিপ্রধান। ঠিকমতো খেতেও পারছেন না। হাত-পায়ের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা। উঠে বসা বা দাঁড়াতেও পারছেন না। কারও সাহায্যে তাকে উঠাবসা করতে হয়। এ নিয়ে বিএনপির কোনো ভাবনাই নেই। নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, বেগম জিয়াকে বিএনপি ভুলেই গেছে। আইনি লড়াইয়ের পথে তাকিয়ে আছে বিএনপির একটি অংশ। আরেক অংশ বলছে, আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। রাজপথে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। রাজপথে আন্দোলন যত শক্তিশালী হবে বেগম জিয়ার জামিন প্রক্রিয়া তত সহজ হবে। 

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা কম। তাই আমাদের রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য আমরা শিগগিরই কর্মসূচি দেব। তবে কী ধরনের কর্মসূচি আসবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। দল পুনর্গঠনের কাজ চলছে। আন্দোলনে যেতে হলে দলকেও শক্তিশালী করা জরুরি।’

খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে অনেকটা নীরব বিএনপির হাইকমান্ড। দেড় বছরে শুধু রাজপথে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ আর শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে বেগম জিয়ার মুক্তি চাইছেন। রাজপথের কোনো শক্ত কর্মসূচিতে যেতে চাইছেন না নেতারা। এতে উটকো ‘ঝামেলা’ বাড়বে বলেও মনে করেন নেতারা। বাস্তবে আত্মকেন্দ্রিক ব্যস্ততায় দলের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা। এরই মধ্যে বিএনপি নেতারা নানা ইস্যুতে পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। একজন আরেকজনকে বিএনপির শত্রু বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। এক ধাপ এগিয়ে সরকারের ‘দালাল’ বা ‘এজেন্ট’ বলছেন। সর্বশেষ পাঁচ এমপির শপথে নেতা-কর্মীদের ধারণা ছিল, বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে সমঝোতার অংশ হিসেবে তারা সংসদে গেছেন। এ নিয়ে দলের সিনিয়র নেতারা বলছেন, এমপিদের শপথের সঙ্গে বেগম জিয়ার মুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই।

এদিকে রাজপথে ‘শক্ত’ কোনো কর্মসূচি না থাকায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীরা। মাঠের নেতা-কর্মীরা বলছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করার মতো কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি। নেতারা সবাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। নিজের অর্থ সম্পদ রক্ষা, নিজের পদ-পদবি, নমিনেশন বা বলয় সৃষ্টি করতে মরিয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ।

তৃণমূল নেতারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে গিয়েছিল বিএনপি। আগের রাতেই ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কর্মসূচি বিএনপি দেয়নি কেন? খালেদার মুক্তি আন্দোলনের কার্যত কিছুই হয়নি। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্ব। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিতে মাঠপর্যায়ের  নেতা-কর্মীরা রাজপথের ‘কঠোর’ কর্মসূচি চান।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া আমাদের নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হয়নি। এখন কাউন্সিলের আগেই তাকে মুক্ত করতে হবে। বেগম জিয়াকে নিয়েই নতুন নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হবে।’

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি লুৎফর রহমান কাজল বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) মুক্তির জন্য আমরা আসলেই সেই অর্থে কিছু করতে পারিনি। সরকারও করতে দেয়নি। এখন আমাদের উচিত হবে, প্রতিটি সাংগঠনিক ইউনিট থেকে অন্তত দুই হাজার নেতা-কর্মীর কারাবরণ করা। এতে কিছুটা হলেও ম্যাডামের জন্য প্রতিবাদ করা হবে।’

রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম আন্দোলনের অংশ হিসেবে। বাস্তবতায় সেই আন্দোলন কিন্তু হয়নি। এটা অবশ্যই দুঃখজনক। তাই কঠিন থেকে কঠিনতম আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা জরুরি।’

কুমিল্লা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান বলেন, ‘বেগম জিয়া জেলে যাওয়ার আগে একটি রুদ্ধদ্বার নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, বেগম জিয়াকে জেলে নেওয়া হলে আন্দোলনের মাধ্যমেই বেগম জিয়াকে মুক্ত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা করতে পারিনি। নির্বাহী কমিটির বৈঠকে যে আন্দোলনের দামামার রব উঠেছিল, সেটা পরবর্তীতে আর হয়নি।’

কিছু দিন আগে গণশুনানিতে অংশ নেওয়া তৃণমূল নেতাদের কণ্ঠেও ছিল ক্ষোভ। বেগম জিয়ার মুক্তিতে কঠোর কোনো কর্মসূচি না দেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক ওই গণশুনানিতে অংশ নিয়ে নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি সবকিছু ভুলতে পারি, কিন্তু আমার মাকে (বেগম জিয়া) মুক্ত করার জন্য আপনারা কোনো কর্মসূচি দিচ্ছেন না। কেন ৩১ ডিসেম্বর কোনো কর্মসূচি দেওয়া হলো না? সব নেতা-কর্মী উজ্জীবিত ছিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে মহাসচিবকে বলতে চাই, আর সহ্য হচ্ছে না।’

এদিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে কারাবন্দী খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। তার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ওঠানামা করছে। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় হাসপাতালে তার চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ জন্য সার্বিক প্রস্তুতি থাকার পরও বিএনপিপ্রধানকে কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। কারা সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের মহিলা ইউনিটে তিনতলার ডিভিশন সেলের ভিআইপি সেলে খালেদা জিয়াকে রাখার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়া বেশ কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত। তিনি রিউমেটিক আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অস্ট্রিও-আর্থ্রাইটিস, টানেল সিনড্রোম, ফ্রোজেন শোল্ডার, লাম্বার স্টোনাইসিস, থাইটিকা, ক্রনিক হাইপো নিথ্রেমিয়া ও কিডনি রোগে ভুগছেন। কয়েকটি  রোগ আগে থেকেই ছিল। কয়েকটি জেলে যাওয়ার পর হয়েছে বলে বিএনপির দাবি। দলটি বলছে, এসব রোগের কোনোটিরই উন্নতি হয়নি। তার বিশেষায়িত হাসপাতালে দীর্ঘমেয়াদি নিয়মিত চিকিৎসা জরুরি। এ জন্য তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ‘খালেদা জিয়া যে রোগগুলোয় ভুগছেন তা অত্যন্ত মারাত্মক। তার বয়স ৭৩-এর পথে। এ বয়সে এ রোগগুলোর যদি নিয়মিত চিকিৎসা না হয়, প্রতিদিন যদি মনিটর না করা হয়, তাহলে তার জীবনের প্রতি মারাত্মক হুমকি এসে যেতে পারে। সরকার কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে।’

উচ্চ আদালতের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য গত বছরের ৬ অক্টোবর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।  সেখানে মাসখানেক চিকিৎসা শেষে ৮ নভেম্বর চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দেওয়ার পর তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত ১ এপ্রিল তাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিন মাস ধরে তিনি এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সর্বশেষ খবর