শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা বেপরোয়া সামাজিক অপরাধে

জিন্নাতুন নূর

বেপরোয়া সামাজিক অপরাধের কারণে এখন উৎকণ্ঠা সব স্তরে। সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে উদ্বেগ। অনেকে বলছেন, সার্বিকভাবে সবকিছুর লাগাম টেনে না ধরলে সমাজে যে বিকৃতি দেখা দিয়েছে তা চলতেই থাকবে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে ধর্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক খুন এবং বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতিমূলক কর্মকা  ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। যা অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। কেন পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকা  ঘটে চলছে এবং তার উত্তরণ প্রসঙ্গে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে নিজেদের

মতামত তুলে ধরেন দেশের সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীসহ নারীনেত্রীরা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজে অতিমাত্রায় উচ্ছৃঙ্খলতা প্রবেশ করছে। মানুষের মধ্য থেকে ভয়ভীতি, লজ্জা মরে যাচ্ছে। সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আর এ ধরনের অপরাধ দমন করতে জরুরি ভিত্তিতে রিসার্চ সেল গঠন এবং তা মনিটর করতে হবে। এ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কাউন্সিলিংও করাতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সমাজে চলতে থাকা এ অপরাধমূলক কর্মকা  সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, আমাদের দেশ তথা সমাজব্যবস্থা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষ ক্রমেই ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সমাজে যেমন অতি মাত্রায় মৌলবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি আছে আবার আকাশ সংস্কৃতির জন্য মানুষের মধ্যে এখন কাজ করছে সীমাহীন আধুনিকতা। তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে পাশবিকতা। আর এমনটি ঘটছে মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট থাকায়। সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ সামাজিক ও পারিবারিক হত্যাকা সহ পৈশাচিক অপরাধমূলক কর্মকা  ঘটাচ্ছে। আর আকাশ সংস্কৃতির জন্য উঁচু শ্রেণির মানুষ আগে যে ধরনের অপরাধমূলক কাজ করত তা এখন সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষরাও করছে। মাদ্রাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে বাসের হেলপার পর্যন্ত যৌন নির্যাতনের মতো অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখন যেভাবে অশ্লীল ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে আবার ফেসবুকে যেভাবে আপত্তিকর মন্তব্য লেখা হচ্ছে তা এ ধরনের অপরাধ করতে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করছে। আবার গণমাধ্যমেও এখন সামাজিক অপরাধের বিভিন্ন নেতিবাচক খবরগুলো ঢালাও করে প্রচার করা হচ্ছে। মোটকথা সমাজ থেকে ভয়ভীতি, লজ্জা মরে যাচ্ছে। আগে যেখানে ধনী লোকের বখাটে ছেলেরা এ ধরনের অপরাধ করত, তা এখন অধ্যক্ষ, ব্যবসায়ী ও বাসের হেলপারসহ সব পেশাজীবী মানুষই লাগামহীনভাবে করে যাচ্ছে। এ জন্য অপরাধীদের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে এ ধরনের কর্মকা  তারা কেন করছে এর তথ্য নিয়ে রিসার্চ সেল গঠন করতে হবে।

জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, আমরা তার লাগাম টেনে ধরতে পারছি না। আমরা লক্ষ্য করছি, মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা নারী কেউই ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আর এ ধরনের অপরাধ সরকারের একার পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। যারা এ ধরনের অপরাধ ঘটাচ্ছে তারা কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। এ জন্য প্রতি পরিবারের অভিভাবকদের এ বিষয়ে সন্তানদের সচেতন করে তুলতে হবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ছোট শিশুদের এখন তাদের অভিভাবকরা মোবাইল ফোনে নানা রকম অ্যাপস ব্যবহার করতে দিচ্ছে কিন্তু তাদের সন্তানদের ওপর এর কুপ্রভাব নিয়ে তারা একবারও ভাবছেন না। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা নেতিবাচক বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার দিচ্ছে যা অপরাধ উসকে দিচ্ছে। এ বিষয়েও আমাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজ ব্যবস্থার একরূপ থেকে আরেক রূপে যাওয়ার এ সময়ে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। আগে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক রীতিনীতি ও পারিবারিক বন্ধন ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধগুলো প্রতিরোধে ভূমিকা রাখত। কিন্তু এখন সেই বন্ধনগুলো হালকা হয়ে গেছে। এসব অপরাধ বন্ধে সময়ের প্রয়োজনে অনেক আইন হয়েছে কিন্তু আইনগুলোর প্রয়োগ সেভাবে হয়নি। এ জন্য সমাজে পারিবারিক ও সামাজিক হত্যাকা সহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে। আমাদের বুঝতে হবে, পারিবারিক মূল্যবোধের ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ আধুনিক সমাজে পা দিচ্ছে। আর যে কোনো সমাজেই এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাওয়ার সময় কিছু পরিবর্তন ঘটে। যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্রে সমাজ পরিবর্তনের সময় আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় পর্নোগ্রাফির বিষবাষ্প সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এ পরিবর্তন প্রতিটি শ্রেণিকে আঘাত করছে।

সর্বশেষ খবর