শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

মধুকণ্ঠী ফেরদৌসি রহমান

ইমদাদুল হক মিলন

মধুকণ্ঠী ফেরদৌসি রহমান

চোখ মেলে দেখি আমার পাশে এক কিংবদন্তি বসে আছেন।

অনেক বছর আগের কথা। বাংলাদেশ বিমানে করে আমেরিকায় যাচ্ছি। সেবারই প্রথম আমেরিকায় যাওয়া। নিউইয়র্কের লেখক সাংবাদিকদের একটি সংগঠন আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দুই দিনের  মিলনমেলা, আনন্দ উৎসব, গান বাজনা আলোচনা। তখনো নিউইয়র্কে বাঙালির সংখ্যা তেমন বেশি না। ধীরে ধীরে বাড়ছে।

 

শুনেছিলাম এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু গুণী লেখক শিল্পী যাবেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসবেন সমরেশ মজুমদার। সমরেশ মজুমদারের কথা কানে এলো, বাংলাদেশ থেকে কারা কারা যাবেন ঠিকঠাক জানতে পারলাম না।

দেশের বাইরে যাওয়ার আগে নানা প্রকারের ঝুটঝামেলা থাকে। সেসব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোর্ডিংপাস ইত্যাদি করিয়ে বিমানে চড়েছি। জানালার পাশে সিট। তখন যাত্রীরা মাত্র বিমানে চড়ছেন। আমি একটু আগেভাগেই উঠে ছিলাম। নিজের সিটে বসে, সিটবেল্ট বেঁধে মাথাটা জানালার দিকে কাত করে মুহূর্তেই ঘুমিয়ে গেলাম। একদিকে আমেরিকায় যাওয়ার উত্তেজনা, অন্যদিকে গত কয়েকদিনের ক্লান্তি, সব মিলিয়ে গভীর ঘুম। কখন প্লেন ছেড়েছে, কখন বাংলাদেশের আকাশসীমা পেরিয়েছে, কিছুই টের পাইনি।

ঘুম ভাঙল হঠাৎই। ঘুম ভাঙার পর নড়েচড়ে বসেছি। সিটবেল্ট খুলে ফেলেছি। পাশ থেকে স্নিগ্ধ কণ্ঠের একজন বললেন, ঘুম ভাঙল?

মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্মিত। সংগীত শিল্পের কিংবদন্তি ফেরদৌসি রহমান বসে আছেন আমার পাশের সিটে! পরনে হালকা ধূসর রঙের চমৎকার শাড়ি। শাড়ির ওপর বনেদি শাল, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা। মুখে তাঁর সেই স্নিগ্ধ সুন্দর মায়াবী হাসি। দৃশ্যটা প্রথমে আমার বিশ্বাসই হলো না। মনে হলো এটা বাস্তব কোনো দৃশ্য না, এটা স্বপ্ন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সেই ঘুম এখনো ভাঙেনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম।

ফেরদৌসি রহমান হাসিমুখে বললেন, আমি বিমানে চড়েছি একেবারে শেষের দিকে। এয়ারপোর্টে আসতে লেট হয়ে গিয়েছিল।

আমি কথা বলতে পারছি না। স্বপ্নের ঘোরলাগা চোখে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।

তিনি হাসিমুখে বললেন, বিমানে চড়ে দেখি আমার ভাইটি গভীর ঘুমে। বেশ লম্বা ঘুম দিয়েছ।

ততক্ষণে ঘোর কেটে গেছে। তাহলে ফেরদৌসি আপাও যাচ্ছেন নিউইয়র্কের অনুষ্ঠানে! সত্যি সত্যি তিনিই বসে আছেন আমার পাশের সিটে? কিন্তু আপা কি আমাকে চেনেন? সেভাবে পরিচয় আপার সঙ্গে কখনো হয়নি। রামপুরা টেলিভিশন ভবনে দুয়েকবার দেখা হয়েছে, পরিচয় সেই অর্থে হয়নি। দুচার কথার পরই বুঝে গেলাম আপা বেশ ভালো করেই চেনেন আমাকে। আমার কয়েকটি লেখার কথাও বললেন, নাটকের কথা বললেন। শুনে আমি কুঁকড়ে গেলাম। ফেরদৌসি রহমান আমার লেখা পড়েছেন, আমার নাটক দেখেছেন? কী সৌভাগ্য! সেই ছেলেবেলা থেকে যাঁর কণ্ঠ মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে আছি, আমার মতো লাখ লাখ ভক্তের স্বপ্নের রাজকন্যা যিনি তিনি আমার মতো নগণ্য একজন লেখকের লেখা পড়েছেন, নাটক দেখেছেন!

বিমান তখন পৃথিবীর কোন প্রান্তের আকাশসীমা পেরোচ্ছে কে জানে। বিমানের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার মন চলে যায় ছেলেবেলায়। স্মৃতির অনেক ভিতরে গান গেয়ে ওঠেন মধুকণ্ঠি এক মহান শিল্পী। ‘পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে’।

শিল্পীর নামের সঙ্গে তখনো ‘রহমান’ যুক্ত হয়নি। তিনি তখন ফেরদৌসি বেগম। বাষট্টি তেষট্টি সালের কথা। আমার আব্বা একটা রেডিও কিনলেন। ‘মারফি’ কোম্পানির রেডিও। আমি বিক্রমপুরের মেদিনীম ল গ্রামে নানীর কাছে থাকি। অন্যান্য ভাইবোন মা বাবার সঙ্গে ঢাকায়। ঈদের ছুটিতে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামে এসেছেন আব্বা। সঙ্গে মারফি রেডিও। তখন কোনো বাড়িতে একটা রেডিও থাকা মানে বিশাল ব্যাপার! পুরো পাড়া ভেঙে পড়ল আমাদের বাড়িতে। কাঠের হাতলঅলা পুরনো আমলের ভারী ধরনের একটা চেয়ার রাখা হলো বাড়ির উঠোনে। সেই চেয়ারে রাখা হলো রেডিও। রেডিওর রংটা এখনো মনে আছে। পেছন দিকটা আর সামনের চারপাশ টকটকে লাল রঙের। নব ইত্যাদির জায়গাটা বিসকিট কালারের। চৌকো ভারী ধরনের রেডিও। আমাদের উঠোন ভর্তি মানুষ। সবাই রেডিও দেখছে। আব্বা নব ঘুরিয়ে রেডিও অন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো এক মধুকণ্ঠির গান ‘পদ্মার ঢেউ রে’। আব্বা বললেন, এটা ফেরদৌসি বেগমের গান। তিনি হচ্ছেন আব্বাসউদ্দিন আহমেদের মেয়ে।

উঠোনভর্তি মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে গান শুনতে লাগল। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই ভিড়ের মধ্যে। এতকাল আগের কথা, এখনো ছবির মতো চোখে ভাসে সেই দৃশ্য। কানে এখনো বেজে ওঠে সেই গান, ‘পদ্মার ঢেউ রে’। মানুষের কণ্ঠ এত সুন্দর হতে পারে?

তারপর শুরু হয়েছিল আমার ঢাকার জীবন। ফেরদৌসি বেগম ততদিনে ফেরদৌসি রহমান হয়ে গেছেন। খবরের কাগজে তাঁর ছবি দেখি, টেলিভিশনে তাঁর গানের অনুষ্ঠান দেখি। ছোটদের জন্য গান শেখার অনুষ্ঠান করেন টিভিতে ‘এসো, গান শিখি’। মুগ্ধ হয়ে ফেরদৌসি রহমানকে দেখি। একজন মানুষ এতদিক দিয়ে সুন্দর হন কী করে? অসাধারণ গান করেন। দেখতে সুন্দর। কথা বলেন মিষ্টি করে। আর হাসি? প্রতি কথায় হাসেন। তাঁর হাসিতে মুহূর্তে আলোকিত হয়ে যায় চারদিক। আর ফেরদৌসি রহমানের কখনই বয়স বাড়ে না। তিনি চিরকাল রয়ে গেলেন আঠারো বছর বয়সে। আমি ফেরদৌসি রহমানের কী পরিমাণ ভক্ত হয়ে উঠলাম, বলে বুঝাতে পারব না।

কখনো কখনো নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি আমি। সামান্য লেখালেখি করে দেশের কত বড় বড় মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি। কত অসামান্য মানুষের স্নেহ মমতা ভালোবাসা পেয়েছি। এক সময় যিনি ছিলেন স্বপ্নের মানুষ, ফেরদৌসি রহমান, নিয়তি আমাকে তাঁর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। তাঁর স্নেহে হৃদয় আচ্ছন্ন হলো।

নিউইয়র্কের ওই অত লম্বা পথে, সারাটা পথ ফেরদৌসি আপা মায়ের মতো করে আগলে রাখলেন আমাকে। এটা খাও ভাইয়া, ওটা খাও। এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। যাও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি তাঁকে দেখি আর মুগ্ধ হই। এত লম্বা জার্নিতেও তাঁর চেহারায় কোনো ক্লান্তি দেখি না। মুখে সেই মিষ্টি হাসিটি। চেহারায় সেই অষ্টাদশীর লাবণ্য।

আমার আগে ইমিগ্রেশন ক্রস করে গেলেন আপা। আমার লাগেজ চেক করা ইত্যাদিতে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে গেল। বেরিয়ে দেখি ফেরদৌসি আপা উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে যাঁরা রিসিভ করতে এসেছেন তাঁদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। না না, মিলন আসুক। ওর কোনো অসুবিধা হলো কি না! আমাকে যাঁরা রিসিভ করতে এসেছেন তাঁরাও দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বেরিয়ে আসার পর এত স্বস্তির একটা হাসি ফুটল আপার মুখে। সেই হাসি এখনো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।

বড় হয়ে উঠছি, স্কুল কলেজের সীমানা ছাড়াচ্ছি আর প্রতিদিনই যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি ফেরদৌসি রহমানকে। একটার পর একটা দুর্দান্ত আধুনিক গান গাইছেন। সিনেমায় গাওয়া তাঁর গানগুলো মানুষের মুখে মুখে। নজরুলগীতি গাইছেন, উর্দু গান গাইছেন। ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির সংগীত পরিচালনা করলেন। আর ভাওয়াইয়া। ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই’। বাংলা সংগীতে ফেরদৌসি রহমানের অসংখ্য গানের কোনো তুলনা মিলবে না। ওইসব গান ফেরদৌসি রহমানেরই গান। আমি গান তেমন বুঝি না। যেটুকু বুঝি তাতে শুধু এইটুকু বলতে পারি, ফেরদৌসি রহমানের তুলনা শুধুই ফেরদৌসি রহমান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তোমার তুলনা তুমি’।

আমেরিকা থেকে ফিরে আসার অনেকদিন পর বিটিভিতে মেনকা আপার (কামরুন নেসা হাসান) রুমে হঠাৎ করে আপার সঙ্গে দেখা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী হয়েছে? মুখটা এত শুকনো কেন?

সেদিন কোনো কারণে বোধহয় ক্লান্ত ছিলাম। আপা এমন করে বললেন, মনে হলো আমার আপনতর একজন মানুষ যেন আমার শুকনো মুখটি দেখে চিন্তিত হয়েছেন। কী যে মায়াবী মানুষ ফেরদৌসি আপা! আপার বড়ভাই ব্যারিস্টার মোস্তফা কামাল সাহেবের মেয়ে নাশিদ কামাল আমার বন্ধু। সেও অসাধারণ সংগীত শিল্পী। খুবই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে আমাদের সময় থেকেই পরিচিত। তার গুরু হচ্ছেন ফেরদৌসি আপা। আপাকে অনুসরণ করে করে সে তাঁর নিজস্ব সংগীত ভুবন তৈরি করেছে। আপাকে সে ডাকে ‘ময়না’। আপা ওকে ডাকেন ‘ইভু ময়না’। নাশিদের ডাকনাম ‘ইভু’। ফেরদৌসি আপার ডাকনাম ‘মিরনা’।

আমেরিকা থেকে ফেরার পর ধীরে ধীরে আপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। খুব যে দেখা সাক্ষাৎ হয় তা না, যখনই কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কী যে স্নেহের গলায় কথা বলেন! মুখে সেই হাসিটি লেগেই থাকে।

আমার বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরের কল্যাণে আমার নামের সঙ্গে ‘উপস্থাপক’ কথাটা যোগ হয়েছে গত কয়েক বছরে। একটা অনুষ্ঠান করতাম এনটিভিতে। ‘কী কথা তাহার সাথে’। ফেরদৌসি আপা এলেন সেই অনুষ্ঠানে। অনেক কথার মাঝখানে আমি হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সব সময় এক রকম। আপনার কখনো বয়স বাড়ে না। রহস্যটা কী? কীভাবে আপনি এতটা মেনটেইন করেন?

আপা তাঁর সেই স্নিগ্ধ হাসিটি হাসলেন। কোনো রহস্য নেই ভাইয়া। তবে ছোটবেলা থেকে একটা জিনিসই আমি মেনে চলেছি, সব সময় হাসিমুখে থাকা। এ ছাড়া আর কখনই কিছু ভাবিনি।

কণ্ঠের মতোই তাঁর রুচি, ব্যক্তিত্ব এবং গুছিয়ে কথা বলা, সব মিলিয়ে ফেরদৌসি রহমান দীর্ঘকাল ধরে তাঁর নিজের জায়গাটিতে বসে আছেন। নিজেকে কীভাবে কিংবদন্তিতে রূপান্তর করতে হয় ফেরদৌসি আপার দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।

ফেরদৌসি আপার পুরনো দিনের কিছু বিখ্যাত গান নতুন করে গাইল নাশিদ। আর ফেরদৌসি আপা গাইলেন কিছু রাগ প্রধান গান। লেজার ভিশন থেকে দুজনের দুটো সিডি বেরোল। সেই সিডির প্রকাশনা উৎসব হবে ‘ছায়ানট’ ভবনে। সাগর আমাকে বলল, অনুষ্ঠান তুমি উপস্থাপনা করবে। গেলাম অনুষ্ঠানে। হলভর্তি অনেক প্রিয়মুখ, পরিচিতমুখ। আপা বসে গল্প করছেন তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে। আমাকে দেখে বললেন, তুমি আমাদের অনুষ্ঠানটা করে দিচ্ছ, খুব খুশি হয়েছি ভাইয়া।

সেদিন যে আপার জš§দিন ছিল এ কথা আমরা কেউ জানতেই পারিনি। তাঁদের পরিবারের সবাই উপস্থিত অনুষ্ঠানে। ব্যারিস্টার মোস্তফা কামাল, মোস্তফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসি আপা, নাশিদ, পরিবারের অন্য অনেকে।

চমৎকার একটা অনুষ্ঠান হলো। এত সুন্দর করে কথা বললেন পরিবারের মানুষগুলো। একটি পরিবারে এত এত গুণী মানুষ জš§াতে পারে? স্টেজে বসে বারবার শুধু এই কথাই মনে হচ্ছিল আমার। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ অমর হয়ে আছেন তাঁর কণ্ঠের জন্য। অন্যদিক দিয়ে ভাবলে তিনি যে তাঁর উত্তরাধিকার রেখে গেছেন তাঁরাও সেই অমর শিল্পীকে আরেক ধরনের অমরত্ব দিয়েছেন তাঁদের শিক্ষা রুচি শিল্পবোধ এবং ফেরদৌসি আপার কণ্ঠ মাধুর্য দিয়ে।

তাঁর জনপ্রিয় গানের একটির কথা এই মুহূর্তে খুব বলতে ইচ্ছে করছে।

আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি।

ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি।

আমরা ভাগ্যবান যে ফেরদৌসি রহমান আমাদের দেশে জম্মেছেন। ইরান তুরানে না পাঠিয়ে পরম করুণাময় তাঁকে আমাদের দেশে পাঠিয়েছেন। ফেরদৌসি আপা, আপনাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর