রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

সামাজিক অপরাধের ভয়ঙ্কর রূপ

হঠাৎ বেড়েছে শিশু হত্যা ধর্ষণ

শামীম আহমেদ, মাহবুব মমতাজী ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সামাজিক অপরাধের ভয়ঙ্কর রূপ

নিহত শিশু সায়মা। স্বজনদের আহাজারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

শিশুদের জন্য ক্রমেই যেন অনিরাপদ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের মাটি। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে শিশু নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যা। ধর্ষকের বিকৃত যৌন লালসা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ৮ মাসের শিশু পর্যন্ত। শিক্ষাঙ্গনেও ধর্ষিত হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থী। ধর্ষণের পর নির্মমভাবে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে অনেক নিষ্পাপ প্রাণ। পৃথিবীকে ঠিকভাবে দেখার আগেই হত্যার শিকার হচ্ছে নবজাতক। পারিবারিক সহিংসতা, প্রতিপক্ষের হাতে গুম, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব অথবা মা-বাবার পরকীয়ার বলি হচ্ছে তাদের শিশুসন্তান। আবার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ¦ ইত্যাদিতে প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে শিশু। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই শিশুদের। চলতি বছরের ছয় মাসে দেশে ২১৮ শিশু খুন হয়েছে। আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৬৬টি। অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ শিশুকে। নিখোঁজ হয়েছে ৭২ শিশু। নিখোঁজের পর ২৪ শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখানে প্রতি মাসে এই চিত্র বাড়তে দেখা গেছে। বেশির ভাগ শিশুই শিক্ষক, বাড়ির কেয়ারটেকার কিংবা স্থানীয় দোকানির হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধকল সইতে না পেরে অনেক শিশু ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। অনেককে আবার প্রমাণ মুছে দিতে হত্যা করা হয়েছে। কারও মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। শুধু শিশু নয়, মধ্যবয়সী থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে- চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১০৯টি। গণধর্ষণ হয়েছে ৩৬টি। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। ধর্ষণের শিকার ছয় বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪৮, ৭-১২ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭১, ১৩-১৮ বছরের তরুণীর সংখ্যা ৪৭, ১৯-২৪ বছর বয়সী যুবতীর সংখ্যা ১৪, ২৫-৩০ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা ৫, ৩০ বছরের উপরের রয়েছে ৫ জন। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। এর মধ্যে ১২ জনই শিশু। আত্মহত্যা করেছে ৪ জন। এসব ঘটনায় সারা দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ২৪৩টি।

সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার ওয়ারীতে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় সামিয়া আফরিন নামে ৭ বছরের এক শিশুকে। ওয়ারীর বনগ্রামের ১৩৯ নম্বর বাসায় এ ঘটনা। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বাড়ির কেয়ারটেকার ফরিদকে আটক করে। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আঠারবাড়ি এলাকায় মা হাওয়া (আ.) কওমি মহিলা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আবুল খায়ের বেলালী নিয়মিত একজন করে শিশু ছাত্রীকে কক্ষে ডেকে নিতেন শরীর টেপাতে। এক পর্যায়ে অবুঝ শিশুদের ধর্ষণ করে দোজখের ভয় দেখিয়ে এ কথা কাউকে বলতে নিষেধ করতেন। সম্প্রতি এক শিশু এ নিয়ে মুখ খুললে ফাঁস হয়ে যায় আবুল খায়েরের অপকর্ম। আটক করার পর আদালতে ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেন ওই প্রধান শিক্ষক। গতকাল তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। ৪ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে হাসপাতালের ক্যান্টিন বয়কে আটক করে পুলিশ। একই দিন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় চতুর্থ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে (১২) ধর্ষণ করার অভিযোগে উপজেলার উত্তমপুর গ্রাম থেকে আলী মাতুব্বর (৫২) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আলী মাতুব্বরের স্ত্রীর কাছে প্রাইভেট পড়তে যেত ওই স্কুলছাত্রী। গত ৮ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকায় মেয়ের বান্ধবী ৮ বছরের এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে হাসান মিয়া (৫০) নামে এক চা দোকানির বিরুদ্ধে। শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। কোচিংয়ে যেতে চাইত না রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ১১ বছরের এক শিশু। জোরাজুরি করায় মেয়েটি মাকে জানায় কোচিংয়ের শিক্ষক তার শরীরের যেখানে সেখানে হাত দেয়। এর পরদিনই মা তার সঙ্গে কোচিংয়ে যান। সেখানে অন্যান্য অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন কোচিং শিক্ষক আবুল হোসেনের ভয়ঙ্কর রূপ। অন্তত পাঁচ শিশু তার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। গত ২৬ জুন রাজধানীর নূরজাহান রোডের ওই কোচিং সেন্টার থেকে আবুল হোসেনকে পুলিশ আটক করে। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী মুখ খুলতে শুরু করে। বেসরকারি সংস্থা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি মাসেই বেড়ে চলছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা। সংস্থাটি বলছে, গত ৬ মাসে ৪৯৬ শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৬০টি, মার্চে ৫২টি, এপ্রিলে ১২২টি, মে’তে ১১৯টি এবং সর্বশেষ জুন মাসে ৯১টি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ২৩টি। মোট শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে ২০৫টি।

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাবা-মা ও নিকটতম আত্মীয়ের পরে বিদ্যালয়ের শিক্ষকই গুরুজন। বাড়ির পরই অভিভাবকরা মনে করেন স্কুল-মাদ্রাসা তাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ স্থান। গত কয়েক দশকে দেশের আনাচেকানাচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাদ্রাসা ও এতিমখানা। অনেক মাদ্রাসা-এতিমখানা আবাসিক। সেখানে নিরাপদ মনে করেই সন্তানদের পাঠানো হয়। শিক্ষক দুশ্চরিত্র হবেন তা কেউ ভাবতেই পারেন না। তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসা-এতিমখানাগুলোর পরিচালনা কমিটি এই বীভৎস অপরাধের দায় এড়াতে পারে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও দায়মুক্তি দেওয়া যায় না। তাদের নজরদারির অভাবেই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ খবর