রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মানুষ গড়ার কারিগর যখন ভয়ঙ্কর

আকতারুজ্জামান

শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ও এই শিক্ষক। সেই শিক্ষকদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠছেন ভয়ঙ্কর ধর্ষক-খুনি! ধর্ষণ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাদের হাত। শিক্ষক নামধারীদের হাতে মাঝেমধ্যেই নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ছাত্রীরা। জোরপূর্বক ধর্ষণ, জিম্মি করে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর ভিডিওচিত্র প্রকাশের হুমকি দিয়ে ফের ধর্ষণ- এসব অপকর্ম করে আসছেন তারা। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়েই শিক্ষকদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন ছাত্রীরা। শুধু ছাত্রীদের ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি শিক্ষক নামধারী এই পিশাচরা, এদের কেউ কেউ ধর্ষণের ভিডিওচিত্র দেখিয়ে জিম্মি করতেন ছাত্রীদের মায়েদেরও! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিরা চিহ্নিত থাকলেও যথাযথ বিচার না হওয়ায় থেমে নেই এসব অপকর্ম।

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কর্তৃক ওই প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্রী নুসরাত জাহানকে দিনের পর দিন যৌন হয়রানির পর সর্বশেষ নির্মমভাবে খুন করার ঘটনাটি সমালোচনার ঝড় তোলে। অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ২৭ মার্চ যৌন নির্যাতনের মামলা করে নুসরাত জাহান রাফির পরিবার। অভিযোগ পেয়ে সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনারই জের ধরে ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ওই অধ্যক্ষের সমর্থকরা। গুরুতর দগ্ধ ওই ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আনা হলে ১০ এপ্রিল তিনি মারা যান। নুসরাতের শরীরের ৮০ শতাংশই আগুনে ঝলসে গিয়েছিল।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার মিজমিজি এলাকার অক্সফোর্ড হাইস্কুলের শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম আরিফ তিন-চার বছর ধরে বিভিন্ন ছাত্রীর সঙ্গে নানাভাবে প্রতারণা করে আসছিলেন। নানা কৌশলে ওই ছাত্রীদের ফাঁদে ফেলে তিনি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এর ভিডিওচিত্র ধারণ করতেন। এরপর সেটি দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের মায়েদের জিম্মি করে তাদের সঙ্গেও একইভাবে যৌনাচার এবং মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করতেন আরিফ। গত মাসে বিষয়টি জানাজানি হলে অভিভাবক ও এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে অভিভাবকরা স্কুলে গিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক আশরাফুল আরিফের মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ছাত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের ছবি দেখে তাকে গণপিটুনি দেন। খবর পেয়ে র‌্যাব ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকসহ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জুলফিকারকেও আটক করে। আটক শিক্ষক আশরাফুল আরিফের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ডিভাইস জব্দ করে কমপক্ষে ২০ জন ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রমাণ মেলে। একই জেলার ফতুল্লা উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল আমিন। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ওই অধ্যক্ষ মাদ্রাসার ১০ থেকে ১২ জন ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন। মাদ্রাসার ভিতরে পরিবার নিয়ে থাকতেন অধ্যক্ষ আল আমিন। বাসায় তার স্ত্রী না থাকলে বা মাদ্রাসা ছুটি হলে নানা কৌশলে অধ্যক্ষ আল আমিন ছাত্রীদের ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানি করতেন। অভিযোগ পেয়ে ৪ জুলাই ওই অধ্যক্ষকে আটক করা হয়। রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে রেজাউল করিম রতন এক ছাত্রীকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে কোমল পানীয়র সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করেন। এরপর তাকে ধর্ষণ করে সেই চিত্র মোবাইলে ধারণ করে রাখেন। এর পর থেকে সেটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তিনি টানা এক বছর ধর্ষণ করে আসছিলেন ওই ছাত্রীকে। তবে ২০১৮ সালে ক্যাডার পরিবর্তন করে পদোন্নতি পেয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হন রেজাউল করিম। এর পরও ভয় দেখিয়ে ওই কলেজছাত্রীকে টানা এক বছর ধরে ধর্ষণ করে আসছিলেন এই উপসচিব। এ ঘটনায় করা মামলার চার্জশিট হওয়ার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন পেয়েই তিনি ওই কলেজছাত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায় হাজীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইনউদ্দিন তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে গত জুনে দাওয়াত দেন কয়েকজন ছাত্রীকে। সেদিনই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে প্রধান শিক্ষক তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের জানালে ঘটনার দুই দিন পর ১১ জুন ওই ছাত্রী বাদী হয়ে বারহাট্টা থানায় মামলা করেন। জানা যায়, শিক্ষক আইনউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে নিজ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, নানা প্রলোভন দেখিয়ে, বেশি নম্বর প্রদান বা পরীক্ষায় উত্তীর্ণের আশ্বাস দিয়ে, ভয়ভীতি প্রদান ও জিম্মি করে কৌশলে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। স্কুলের মেধাবী সুন্দরী ছাত্রীদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিজ কক্ষে আটকে রেখে তিনি শারীরিক সম্পর্কেও বাধ্য করতেন।

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার রাখালিয়া গ্রামে রাখালিয়া মাদ্রাসাতুন নুরের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী প্রতিদিনের মতো মাদ্রাসায় পড়তে গেলে শিক্ষক মাওলানা নুর ইসলাম ওই ছাত্রীকে তার আবাসিক কক্ষে ডেকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এ সময় তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শিশুটির মা নাজমা আক্তার রায়পুর থানায় মামলা করলে পুলিশ হায়দারগঞ্জ এলাকা থেকে শিক্ষক নুর ইসলামকে গ্রেফতার করে। নাটোর সদর উপজেলার চন্দ্রকোলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজের ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করেন ওই কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক আবদুল জলিল। এ ঘটনায় ওই শিক্ষকের স্ত্রী অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত প্রতিবেদন ও কারণ দর্শানোর ভিত্তিতে মে মাসে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

বরগুনা জেলার সদর থানার কেওড়াবুনিয়া এলাকায় সাহেবের হাওলা রাফেজিয়া দাখিল মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে গাইড বই দেওয়ার কথা বলে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন মাদ্রাসার শরীরচর্চা বিষয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম। গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

সর্বশেষ খবর