মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

চা চাষিদের মাথায় হাত

পঞ্চগড়ে চা পাতা সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা, চাষিদের কাছ থেকে কারখানা মালিকরা কিনছে মাত্র ১২-১৫ টাকা, চা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকেই

মাহমুদ আজহার, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে ফিরে

দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মমিনপাড়ার তরুণ চা চাষি মো. আশরাফ হোসেন রুবেল। অনেক কষ্টে তিনি ৮ একর জমিতে চা চাষ করেছেন। কিন্তু সব জমিতে চাষ করে এখন চরম বিপদে পড়েছেন। চা পাতার ন্যায্য মূল্য তো পাচ্ছেনই না, বরং খরচের টাকাও উঠছে না তার। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানালেন, সরকার নির্ধারিত চা পাতার মূল্য প্রতি কেজি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু কারখানা মালিকরা চা পাতা কিনছেন মাত্র ১২-১৫ টাকায়। প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৪-১৫ টাকা। আবার ২০ থেকে ৩০ ভাগ পাতা কেটে নিচ্ছে চা কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে প্রতিবাদও করা যায় না। সরকারের এ বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। নইলে চা চাষিরা আগ্রহ হারাবে। নজর দেবে অন্য চাষাবাদে। শুধু আশরাফ হোসেন রুবেলই নন, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওজুড়েই চা চাষিদের একই অবস্থা। তাদের এখন মাথায় হাত। ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে চা চাষ শুরু করেন ক্ষুদ্র চাষিরা। অনেক বেকার তরুণ চা চাষ করে কেবল আলোর মুখ দেখা শুরু করছিলেন। পঞ্চগড়ের অর্থনীতিতেও চাঙ্গাভাব আসা শুরু হয়। ঠিক এ মুহূর্তেই চা পাতা বিক্রিতে ব্যাপক ধস নামে। এ নিয়ে পঞ্চগড়ের চাষিরা সম্প্রতি রাস্তা অবরোধ করে মানববন্ধনও করেছেন। জেলা প্রশাসকের কাছে দিয়েছেন স্মারকলিপিও। জেলা প্রশাসন থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনো সুফল মিলছে না। বাধ্যবাধকতা থাকায় অনেকে চায়ের পাতা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখছেন। তেঁতুলিয়ার আরেক ক্ষুদ্র চা চাষি মোহাম্মদ জুবায়েদ ইকবাল রাহেল। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানান, ‘চাষিরা ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে দায়ী অকশন মার্কেটও। তারা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে চা পাতা কম দামে ক্রয় করছে। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে চায়ের দাম কিন্তু কমছে না। এ ছাড়া ভারত থেকে নিম্ন মানের চায়ের শুকনো পাতি আসছে। এতে আমাদের বাজারে চা পাতা বিক্রিতে প্রচ  প্রভাব পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। নইলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে চরম আঘাত হানবে।’

এদিকে কারখানা মালিকরা বলছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে চোরাই পথে নিম্ন মানের চায়ের পাতি আসছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড়ের চা চাষিরা পড়ছেন চরম বিপদে। কারখানাও বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এরই মধ্যে ইম্পেরিয়াল, গ্রিন কেয়ার ও টিটিসিএল নামে তিনটি চা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চায়ের ন্যায্য বাজার ফিরে না এলে আরও কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানান তারা। একই সঙ্গে তারা এ ব্যাপারে অকশন মার্কেটের দরপতনকেও দায়ী করেন। অকশন মার্কেটে বাজারের স্বাভাবিক গতি না থাকায় চাষিদের পাশাপাশি কারখানা মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মনে করেন কারখানা মালিকরা। তবে চা চাষিদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে, যাতে চাষিরা সময়মতো চা পাতা সরবরাহ করতে না পারেন। বাগান থেকে চা পাতা উত্তোলনের পর কারখানায় সরবরাহ পর্যন্ত নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন চাষিরা। অথচ গত বছর এ সময় কারখানা মালিকরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে চাষিদের কাছ থেকে পাতা ক্রয় করেছিলেন। মৌসুম শুরু হতেই কারখানা মালিকদের মাঝে শুরু হয় টালবাহানা। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই গত দুই মাস ধরে ১৩টি কারখানা ১৫ টাকা কেজি দরে চা পাতা কিনতে শুরু করে। এ অবস্থায় বিপাকে পড়ে ক্ষুদ্র চা চাষিরা। এতে দেশের সম্ভাবনাময় চা শিল্প পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়ছে।

সম্প্রতি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ক্ষুদ্র চাষিরা চা পাতার ন্যায্য মূল্যের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে। উপজেলার শালবাহান রোড বাজার এলাকায় তারা বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ মহাসড়কের ওপর শুয়ে পড়েন। পরে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু ঘটনাস্থলে এসে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতার আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন। এরপরও চাষিরা চায়ের ন্যায্য মূল্য দূরের কথা উৎপাদন খরচই পাচ্ছেন না।

তেঁতুলিয়ার চা চাষি মুহিত হাসান তপু জানালেন, চা পাতা উৎপাদনের শুরুতেই কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বড় বাগান মালিকদের তেমন ক্ষতি হবে না; কিন্তু পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র চাষিরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমেই মূল্য বিপর্যয়ের কারণে চাষিদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। আমরা চা চাষিরা এখন কারখানা মালিকদের হাতের পুতুল। কারখানা মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই আমাদের চলতে হচ্ছে। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের তেঁতুলিয়া উপজেলা সভাপতি হাবিবুর রহমান হবি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে সরকারিভাবে একটি চা কারখানা স্থাপন করার কথা ছিল, সেটি দ্রুত স্থাপন করা হোক। সেই সঙ্গে পঞ্চগড়ের সব চাষিকে একটি বিক্রয় কেন্দ্রে চা বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে কারখানা মালিকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী চা কিনে নিয়ে যাবেন।’

পঞ্চগড় জেলা স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামাল উদ্দিন বলেন, ‘চায়ের ভরা মৌসুমে এখন তারা কৌশল করে দাম কমিয়ে দিয়েছে। তারা অকশন মার্কেটে নিম্ন মানের চা নিয়ে যাচ্ছে। তাই দাম কম পাচ্ছে। আর সেই দায়ভার চাষিদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর