বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

তুরাগ তীরে লঙ্কাকাণ্ড

সাভারে রাজউকের জলাধার আইনের প্রতি ভুঁইফোড় কোম্পানির বৃদ্ধাঙ্গুলি, উৎকণ্ঠায় পরিবেশবাদীরা, মন্ত্রী বললেন ব্যবস্থা নেব

সাঈদুর রহমান রিমন

তুরাগ তীরে লঙ্কাকাণ্ড

সাভারে এভাবেই খাল জলাশয় দখল করে নির্মাণ হচ্ছে আবাসিক এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই ‘ড্যাপ’ লঙ্ঘন করে জলাশয় ভরাটের ভয়ঙ্কর কা- চলছে তুরাগ তীরের বিরুলিয়ায়। সেখানে প্রিয়াংকা কালচারাল একাডেমির সাইনবোর্ডের আড়ালে শত শত একর জলাভূমি নিশ্চিহ্ন করা হলেও বাধা দিচ্ছে না কেউ। অজ্ঞাত ক্ষমতায় দাপুটেরা রাতের আঁধারে ইট-সিমেন্টের প্রাচীর তুলে হাজার হাজার ট্রাক বালু ফেলে ভরাট করছে জলাভূমি। মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে উন্মুক্ত জলাধার। এতে হুমকিতে পড়েছে তুরাগ নদ ও আশপাশ এলাকার জলাভূমি। স্থানীয় বাসিন্দাসহ ভূমির মালিকরা বাধা দিয়েও দখলবাজ বাহিনীর সামনে টিকতে পারছেন না। তারা সাভার থানায় একের পর এক জিডি ও অভিযোগ দাখিল করে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ধরনা দিয়েও বালু ভরাটের অভিশাপ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। উল্টো ভুঁইফোড় হাউজিং প্রতিষ্ঠান প্রিয়াংকার মালিক সাইদুর রহমান সজল জমির মালিকসহ এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রশাসনিক হয়রানি চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এলাকাবাসীর ওপর জোর-জুলুমের কোনো অভিযোগ থানা পুলশ আমলে নিচ্ছে না। অন্যদিকে রাজউকও নির্বিকার। অথচ প্রিয়াংকার সাধারণ জিডির ঘটনাতেও বেশ কয়েকটি পরিবারকে পুলিশ গ্রামছাড়া করে ছেড়েছে। তারা বাড়িঘরে থাকতে পারছে না, এলাকায় এসে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না। সাভার থানা পুলিশ রীতিমতো ওই প্রতিষ্ঠানটির ভাড়াটে বাহিনীর ভূমিকায় নেমেছে বলেও অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদরা বলছেন, এভাবে জলাশয়ের জায়গা দখল করে হাউজিং করলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। হুমকিতে পড়বে রাজধানী ঢাকা। উন্মুক্ত জলাশয় ভরাটের লাগামহীন দৌরাত্ম্যের কারণে ঢাকা বাঁচানোর ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ (ড্যাপ) বাস্তবায়ন এরই মধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ড্যাপ লঙ্ঘন করে, জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা বা আবাসন গড়ে তোলার অনুমোদন আমরা কিছুতেই দেব না। প্রকৃতি পরিবর্তন করে কোনো কিছুই করতে দেওয়া হবে না। এমন কেউ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিরুলিয়ায় জলাভূমি ভরাট করে কেউ আবাসন গড়ে তুললে সে আইন অমান্য করেছে। বিষয়টি আমি দেখব। এমন হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির ফাঁকেই বিরুলিয়া গ্রামের পূর্ব পাশ থেকে নাইরাদী গ্রাম পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ জলাশয়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়েছে ‘সজল বাহিনী’। বাঁধের অভ্যন্তরে থাকা শত শত একর জলাশয় ভরাট হচ্ছে প্রতি রাতে। এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়্যিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিরুলিয়া, খেয়াঘাট, নাইরাদী এলাকার বাসিন্দারা কতিপয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাতের আঁধারে জলাশয় ভরাট-সংক্রান্ত কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি করেন থানায়। তৎক্ষণাৎ পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় এবং জলাধার ভরাটের অপকর্ম বন্ধের ব্যবস্থা নেয়। ওই এলাকায় একের পর এক মিথ্যা মামলা সাজিয়ে সাধারণ বাসিন্দাদের গ্রামছাড়া করার অভিযোগটি আমি নিজে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক, স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নদী ও প্লাবনভূমি ভরাট হয়ে গেলে বন্যাসহ স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। নদীকে আদালত জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দিয়েছে। নদী হত্যা ও মানুষ হত্যা সমান অপরাধ। শুকনো মৌসুমে নদীতে যতটুকু পানি থাকে সেটুকুই শুধু নদী নয়। বর্ষায় যতদূর প্লাবিত হয় সবটা নিয়েই নদী। বর্ষায় নদীকে বাড়তে না দিলে নদী মরে যায়। নদীর পাশের জলাভূমিকে সাদা চোখে নদীর অংশ মনে না হতে পারে। কিন্তু এটা নদীর বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল। নদীর প্লাবনকে ধারণ করে। এই প্লাবনভূমি ভরাট করা বা বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। রাজউকের আইন, জেলা প্রশাসকের ভূমি আইন, পরিবেশ আইনসহ অনেকগুলো আইনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। নদী ও জলাভূমি ভরাট আইনি ও প্রকৃতিগতভাবে হন্তারক সিদ্ধান্ত। প্লাবনভূমি ভরাট করলে নদীরও মৃত্যু হয়। বিআইডব্লিউটিএ, রাজউক, জেলা প্রশাসন- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব নদ-নদী, জলাভূমি রক্ষা করা। জনগণ দেশ চালায় না, তারা জানান দিতে পারে, গণমাধ্যম প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা সেটা না করলে বুঝতে হবে, এর সঙ্গে তারাও জড়িত। সরকারকে এই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ড্যাপের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর বন্যাপ্রবাহ এলাকা, জলাশয় ও কৃষিজমিতে কোনো রকম স্থাপনা নির্মাণ, এমনকি ভূমির প্রকৃতি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। উপরন্তু ড্যাপভুক্ত এলাকায় বেদখল হওয়া ডোবা-নালা, খাল, জলাশয় পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার কঠোর নির্দেশ দিলেও বিরুলিয়ায় জলাশয় নিশ্চিহ্ন করা বন্ধ হচ্ছে না। সেখানে সরকারি খাল, হালট, ব্যক্তিমালিকানার জমিতে ১০-১২ ফুট উচ্চতায় বালি ফেলে মুহূর্তেই প্লটে রূপান্তর করা হচ্ছে। রাতের আঁধারে বালু ভরাট করা জায়গার সেসব জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতেও মালিকদের বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে উন্মুক্ত জলাশয়গুলো একে একে ভরাট করা হলেও রাজউকসহ ড্যাপ-সংশ্লিষ্টরা কেউ কোনো রকম বাধা দিচ্ছেন না। স্থানীয় অধিবাসী মোখলেসুর রহমান, মাসুদুর রহমান, সাজ্জাদ হোসেন, মিন্টু সরকার, বিনয় চন্দ্রসহ অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বড় কাঁকর, খেয়াঘাট, বিরুলিয়া, কাকাবো ও নাইরাদী গ্রাম ঘিরে থাকা বিশাল জলাশয় রীতিমতো নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করে। এ জলাশয় তুরাগ নদের সঙ্গে মিলেমিশে টঙ্গী পর্যন্ত বিরাট এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। জলাশয়ের কারণে যুগ যুগ ধরেই জমির মালিকরা মাত্র একটি ফসল পেলেও সারা বছর মাছ আর সবজির কোনো কমতি থাকে না তাদের। এখানকার মাছ ও সবজি রাজধানীতে সরবরাহ করে আর্থিকভাবে অনেক বেশি লাভবান হন তারা।

রাজউক সূত্র জানায়, ড্যাপ নির্দেশিত ম্যাপের মধ্যে নতুন করে কোনো স্থাপনা গড়া বা জলাশয় ভরাট করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যারা গড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তুরাগপাড় ঘেঁষে ও ড্যাপ নির্দেশিত ম্যাপের মধ্যে যারা অবৈধভাবে ভরাট করেছেন, তাদের নোটিস দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রিয়াংকা হাউজিং ও শুটিং স্পট অন্যতম। সম্প্রতি তাদের নোটিস দেওয়া হয়েছে। তাদের অবৈধভাবে স্থাপন করা একটি সাইনবোর্ডও ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে দখলের অভিযোগ পাওয়ার পর পরিদর্শনের জন্য গঠিত টিম ইতিমধ্যে ওই সব স্থান পরিদর্শন করেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পর আবারও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সূত্রে জানা যায়, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের বড় কাঁকর, খেয়াঘাট, কাকারো ও নাইরাদী ড্যাপ পরিকল্পনার মধ্যে পড়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই অঞ্চলটি বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ এই অঞ্চলে উন্মুক্ত জলাধার থাকবে। কাজেই এখানে জলাধার ভরাট বা ভূমি উন্নয়নেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা না করে জলাধার ভরাট চলছে, যা পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করবে। এতে অতিবন্যাসহ জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ড্যাপ নির্দেশিত এলাকায় জলাশয় ভরাট বা ভূমি উন্নয়নে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবু বিরুলিয়ায় একাধিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবৈধভাবে জলাশয় ও বালু ভরাটের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। কাজ বন্ধ করতে নোটিসও পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানাকেও অবহিত করা হয়েছে। অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান করতেও সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর