বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
ঢাকায় সম্মেলনে বান কি মুন

বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক জলবায়ু অভিযোজনে

নিজস্ব প্রতিবেদক

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে প্রজ্ঞা দেখিয়েছে,  তা আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর অনেক কিছু শেখার আছে। অভিযোজনের বিষয়ে শেখার জন্য বাংলাদেশ সর্বশেষ্ঠ। ২০০৯ সালে জাতীয় অভিযোজনের কর্মপরিকল্পনা সৃষ্টি করে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হয়েছিল। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’ বিষয়ে ঢাকা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন ও এর প্রভাব মোকাবিলায় ধারণার উন্নয়নে গঠিত কমিশনেরও চেয়ারম্যান তিনি। এই সম্মেলন থেকে জাতিসংঘের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের বিষয়ে সুপারিশমালা তৈরি করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সাবেক এ মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা থেকে শিখতে আমরা ঢাকায় এসেছি। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় যেখানে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, সেখানে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ফণিতে ১২ জনের প্রাণহানি হয়। যথার্থ আবহাওয়া পূর্বাভাস, কমিউনিটিভিত্তিক পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও সাইক্লোন শেল্টার থাকার ফলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই ১৬ লাখ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। অভিযোজন অনুশীলনে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার যে নেতৃত্ব অর্জন করেছে তা অলৌকিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ সময় নেদারল্যান্ডসের সাহায্যে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর আওতায় দুর্যোগ মোকাবিলা সক্ষমতায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। সম্মেলনে উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় একটা অভিযোজন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন বান কি মুন। ১০ দিন আগে চীনের বেইজিংয়ে একটি অভিযোজন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সাক্ষাৎ পর্বে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট হিলদা সি হেইনও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইনসানুল করিম জানান, বান কি মুনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন করেছিলেন। বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে শুধু মানুষ নয় পশুপাখিদেরও নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা ছিল।

রোহিঙ্গাদের কাছে শুনলেন ফিরে যাওয়ার আকুতি : উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে গিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন শুনলেন রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি। আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন’-এ যোগ দিয়ে গতকাল তিনি উখিয়া-টেকনাফের পরিবেশ বিপর্যয় অবলোকনসহ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে তিনি ক্যাম্প-২০-এর মাঝে করা হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। তার সঙ্গে আসেন মার্শাল আইল্যান্ডসের রাষ্ট্রপতি হিলদা হিনে এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা প্রমুখ।

, নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ব্রোগ ব্রেন্ডে ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ স্কেফার, ত্রাণসচিব শাহ কামাল, পররাষ্ট্রসচিব মো. শহিদুল হকসহ পদস্থ ডজন খানেকের বেশি কর্মকর্তা। তাদের আগমন উপলক্ষে কক্সবাজার শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্পটসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, হেলিকপ্টারযোগে ক্যাম্প-২০-এর হেলিপ্যাডে অবতরণের পর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন উখিয়ার কুতুপালং ২০ নম্বর ও ১৭ নম্বর ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নর-নারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভাব অভিযোগ ও দাবি দাওয়া শোনেন।

২০ নম্বর ক্যাম্পের হেডমাঝি সিরাজুল মোস্তফা জানান, ক্যাম্প পরিদর্শনকালে বান কি মুন চলমান বৈরী আবহাওয়ায় রোহিঙ্গাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, আবাসন বিষয়ে নানা দিক নিয়ে প্রশ্ন করেন। এ সময়  রোহিঙ্গারা অতিবৃষ্টিতে ভোগান্তিসহ শঙ্কা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করার কথা তুলে ধরেন। তারা তাদের আশ্রিত জীবন থেকে মুক্ত করে নাগরিক অধিকার নিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সহযোগিতার দাবি জানান। তারা বান কি মুনকে জানান, ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া বর্বরতা আর না হওয়ার নিশ্চয়তাসহ অধিকার পেলে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে প্রস্তুত।

এ সময় রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রতিনিধিদল ১৭ ও ২০ নম্বর ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি অবলোকন করেন। শেষে বান কি মুন রোহিঙ্গাদের দাবির প্রতি সহমত পোষণ করে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আগমন উপলক্ষে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কসহ ক্যাম্প অভ্যন্তরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সময়ের অভাবে কুতুপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার এলাকার প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়। ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে বান কি মুনের দল ক্যাম্প ত্যাগ করেন বলে জানিয়েছেন কুতুপালং আন- রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ নুর।

এর আগে সকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশনের (জিসিএ) ঢাকা বৈঠকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ুু সংকট  মোকাবিলায় বিশ্বের কাছে শিক্ষকে পরিণত হয়েছে। অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে বিশ্বের অনেক কিছু শেখার আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা এখানে এসেছি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শুনতে ও জানতে। এ ক্ষেত্রে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাথমিক শিকার তারা আমাদেও সেরা শিক্ষক এবং তারা খোলা মনে আমাদের  শেখাবেন।

বান কি মুনের মতে, বাংলাদেশ ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশ রয়েছে যারা সারা পৃথিবীকে এ বিষয়ে শেখাতে পারে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ হলো সেরা। ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাবে। সাগরের উচ্চতা সামান্য বৃদ্ধি পেলেই রাজধানী শহর ঢাকাও জলমগ্ন হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেন বান কি মুন।

প্রসঙ্গত, বান কি মুন ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন’ এ যোগ দিতে দুই দিনের সফরে মঙ্গলবার বিকালে বাংলাদেশে আসেন। এ আগমনে বান কি মুন তাঁর সফরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনের কর্মসূচিও রেখেছিলেন এবং তা পরিদর্শনও করেন।

সর্বশেষ খবর