শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে স্বাস্থ্য খাতের সেই মাফিয়া

রাঘববোয়ালদের সঙ্গে গভীর সখ্য তদন্তে ফাইল ধামাচাপা

সাঈদুর রহমান রিমন

স্বাস্থ্য খাতের শীর্ষ মাফিয়া খ্যাত সেই ঠিকাদার এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। জালিয়াতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তদন্ত থেমে আছে দুদকে। গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে তার বিষয়ে টুঁশব্দটিও করা হচ্ছে না, তদন্তের বিষয়াদিও চাপা পড়ে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য খাতের সেই গডফাদারের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছিল। তদন্ত অনেকটা এগিয়েও ছিল। স্বাস্থ্য খাতের সেই ঠিকাদারের যাবতীয় কর্মকা  ও তার নামে-বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠায় দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে তার সহায়সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকেই রহস্যজনক কারণে সেই তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে আছে। কিন্তু থামেনি সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৌরাত্ম্য। বরং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তার সিন্ডিকেটের নতুন সদস্য হয়েছেন, নিত্যনতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে তার। ফলে এখনো তার অঙ্গুলি হেলনেই চলছে স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় টেন্ডার, সরবরাহ ও কেনাকাটার কাজ। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেই ঠিকাদারের নামে-বেনামে থাকা ১৬ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও পরিচালককে লেখা দুদকের চিঠিতে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ ঠিকাদারি ব্যবসায় দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ’ বিষয়ে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নানা

            তথ্য চাওয়া হয়। চিঠিতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন, সেবা খাতে যেসব কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে, চলমান আছে এবং ওষুধ-মালামাল-যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোর প্রশাসনিক অনুমোদন, বরাদ্দপত্র, প্রাক্কলন-টেন্ডার, কোটেশন, দাখিলকৃত টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কার্যবিবরণী, কার্যাদেশ, কার্যসমাপ্তি প্রতিবেদনসহ প্রাসঙ্গিক সব রেকর্ডপত্র ২০১৬ সালের ৩০ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু পরে কয়েক দফা তাগিদ দেওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এসব রেকর্ড আর দুদককে দেওয়া হয়নি। দুদক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট শাখার তৎকালীন লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শামিউল ইসলামের কাছেও চিঠি দেয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ না করায় ওই বছরই দ্বিতীয় দফায় আবারও চিঠি দেয় সংস্থাটি। তবে অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত আর এগোয়নি। বরং চিঠি চালাচালির কৌশলবাজিতেই বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে দুদকও আর বিষয়টি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে পাহাড়সম দুর্নীতি-লুটপাটের তদন্ত থেমে রয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে তার ছিল একক রাজত্ব : গত প্রায় এক যুগ ধরেই স্বাস্থ্য খাতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্য খাতে অধিকাংশ দুর্নীতির সঙ্গে তার জড়িত থাকার অনেক প্রমাণ রয়েছে দুদকের কাছে। সরকারের প্রথম পাঁচ বছর স্বাস্থ্য খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে এই সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ওই সময় লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার অসংখ্য ঘটনাও ঘটেছে। মহাজোট সরকারের শেষ বছরে কোনো কোনো হাসপাতালে একসঙ্গে তিন বছরের টেন্ডার করে রাখা হয়েছিল।

বহুল আলোচিত সেই সিন্ডিকেট বলতে গেলে গত এক দশক ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জাল বিস্তার করে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানসমূহে তার এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্টই তার হয়ে কাজ করে। কখনো ওপরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয়, কখনো অর্থের লেনদেনে ম্যানেজ করা হয়, আবার তাতে কাজ না হলে হুমকি-ধমকি দিয়ে কাজ আদায় করা হয়। সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালেই সিন্ডিকেটের প্রচ  দৌরাত্ম্য রয়েছে। এসব জায়গায় মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার নামে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

সেই সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময়। হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে তার সিন্ডিকেট আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মাফিয়ার হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। অনেক মন্ত্রী-সচিব ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত তার। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের সময় অর্থ-বিত্ত, প্রভাবে প্রভাবশালী হাওয়া ভবনের সেই দাপুটে ঠিকাদার নতুন সম্পর্কের মাধ্যমে রীতিমতো ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। এ সময় ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া লাগামহীন লুটপাট চালান তিনি। এমনকি কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। শিষ্যদের দুদকে তলব : পালের গোদা স্বাস্থ্য সেক্টরের শীর্ষ মাফিয়ার বিষয়টি দুদকে ধামাচাপা পড়ে থাকলেও চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ দুদক স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। মাফিয়ার দুর্নীতির সহযোগী শিষ্য খ্যাত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেন দুদক কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানভুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের সবাই কোটি কোটি টাকার মালিক, বেশুমার সম্পদ তাদের। এ সময়ই দুদক কর্মকর্তারা একজন উচ্চমান সহকারী পদধারী হাজার কোটি টাকার মালিক আবজালকে আবিষ্কার করেন। আবজাল ছিলেন সেই মাফিয়ার সব অপকর্মের প্রধান সহযোগী। আবজালের সূত্র ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ইউনিটের ৪৭ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারেও তদন্ত চালায় দুদক। এর মধ্যে ৯ জানুয়ারি দুদকের উপপরিচালক শামসুল আলম স্বাক্ষরিত নোটিস স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়। এতে চারজনকে তলব করা হয় দুদকে। তারা হলেন পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) ডা. আবদুর রশীদ, পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন। এ চিঠিতে ১৪ জানুয়ারি হাজির হওয়া আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ১৬ জানুয়ারি আরও পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তলব করা হয়। এরা হলেন ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক রাকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম।

সর্বশেষ খবর