রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাদকে একশ মাফিয়া

আছেন জনপ্রতিনিধি । রাজনৈতিক নেতা-কর্মী রাঘববোয়াল । ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে গডফাদাররা

মির্জা মেহেদী তমাল ও সাখাওয়াত কাওসার

মাদকে একশ মাফিয়া

দেশের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন ১০০ ব্যবসায়ী। সরকারের মাদকবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স ক্রাশপ্রোগ্রাম’-এর পরেও এই ১০০ বিগশট রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বেশির ভাগই জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রত্যেকেই ধনাঢ্য ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ বিদেশে সেকেন্ড হোম করেছেন মাদক বিক্রি করে। মূলত মাদকের এই গডফাদারদের কারণেই বন্ধ হচ্ছে না দেশের মাদক ব্যবসা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য দিয়ে বলেছে, টেকনাফে ১০২ মাদক ব্যবসায়ীর আত্মসমপর্ণ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী নিহত হন। কিন্তু ধরা পড়েননি টপ মোস্ট মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের নাগাল ছুঁতে পারেনি কেউ। সূত্র জানায়, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে এমন এক থেকে দুজন করে গডফাদার। তবে কক্সবাজারে মাদক গডফাদারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। হালে পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভিন্ন পথে ব্যবসা চালাচ্ছেন। তারা রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছেন। যে কারণে ইয়াবা বন্ধের পরিবর্তে সরবরাহ বেড়ে গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্ত করা হয় ‘টপ টেন লিস্ট’। জেলাভিত্তিক শীর্ষ গডফাদারদের তালিকা ধরে ক্রাশপ্রোগ্রাম শুরু হয়। যেখানে ৬৪ জেলার ৬৫০ বিগশটের নাম ছিল। এর মধ্যে অন্তত ১০০ ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করছেন। তারাই মাদকের নিয়ন্ত্রক। ভিন্ন ব্যবসার আড়ালে করছেন মাদক ব্যবসা। সূত্র জানায়, তারা শুধু মাদক ব্যবসায়ী নন, তাদের অনেকের কাছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্রও আছে, যার প্রমাণ মেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময়। গ্রেফতার অভিযানের সময় তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সমূলে বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে মাদকবিরোধী উচ্চমাত্রার অভিযান অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে কারও কোনো রাজনৈতিক বিশেষ পরিচিতিও বিবেচনায় নেওয়া হবে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাঁড়াশি মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক শীর্ষ ব্যবসায়ী পলাতক রয়েছেন। তবে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত। এতে তারাও সন্ত্রস্ত থাকছে।

নিজেদের সাফল্যের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেখুন আইস আমাদের দেশের জন্য একটি নতুন মাদক। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে এর প্রচুর অপব্যবহার হচ্ছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তবে আমাদের দেশে এটি ছড়ানোর আগেই সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। একই সঙ্গে খাত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা বলব শতভাগ।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্্) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে র‌্যাবের ব্যাপক সফলতা রয়েছে। মাদকের ওপর র‌্যাব সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে এককভাবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রত্যেকটি কর্নারের অংশগ্রহণ। প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।

শীর্ষ অনেক মাদক ব্যবসায়ী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখুন র‌্যাব অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখে। কেউই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে না। হয়তো কেউ কেউ আত্মগোপনে কিংবা পলাতক। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে কথাটি সঠিক নয়। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও কেন থামছে না মাদক- এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আশ্রিত অনেক রোহিঙ্গা যুবক রাতের আঁধারে মিয়ানমার ঢুকে ৩/৪ হাজার ইয়াবাসহ আবার ফিরে আসছে। এমন তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কিছু শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ধরাছোঁয়ার বাইরে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কিছু নতুন ব্যবসায়ীর নাম শুনছি। কিছু শীর্ষ ব্যবসায়ী যারা পলাতক আছেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে তাদের নেটওয়ার্কও আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকার প্রথমেই যার নাম আছে, তিনি হলেন আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সাবেক এই এমপির স্ত্রী এখন তার আসনের এমপি। অথচ তিনি আছেন প্রকাশ্যেই। তার সম্পর্কে সূত্রটি জানায়, তিনি ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তবে ব্যবসায় সরাসরি জড়িত হন না তিনি। তার ইচ্ছার বাইরে বা অজান্তে ইয়াবা ব্যবসা প্রায় অসম্ভব।

চট্টগ্রামের গার্মেন্ট, আমদানি-রপ্তানি ও জাহাজ ব্যবসায়ী সাইফুল করিম ছিলেন আরেক নিয়ন্ত্রক। যদিও ক্রসফায়ারে গত মাসে টেকনাফে তিনি নিহত হন। চট্টগ্রামে এখনো বহাল মঞ্জুর আলম ওরফে মঞ্জু সওদাগর ওরফে কানা মঞ্জু ও রেজাউল করিম ওরফে ডাইল করিম। জানা গেছে, মঞ্জুর আলম চট্টগ্রাম শহরের একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। তিনি দেশের অন্যতম প্রধান ইয়াবা চোরাকারবারি। তার বাবার নাম হাজী আবদুল করিম। গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া থানার রূপকানিয়ায়। চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দীন বাজারে ফলের গলিতে তার ইয়াবার পাইকারি মোকাম রয়েছে। র‌্যাব জানায়, ব্যক্তিগত পাজেরো গাড়িতে পাচারের সময় প্রায় ৮ লাখ ইয়াবাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিল মঞ্জু। চট্টগ্রাম শহরেই তার অন্তত পাঁচটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, মার্কেট ও তিনটি বাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদক মামলার সংখ্যা প্রায় ১৫টি। তালিকায় থাকা রেজাউল করিমও ইয়াবার বড় মাপের পাইকারি বিক্রেতা ও গডফাদার। তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা রয়েছে। রেজাউল করিম চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম জেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ফারুক ক্রসফায়ারে মারা গেলেও বরিশাল কলোনির আরেক গডফাদার রয়েছেন। নাম তার ইউসুফ। তবে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েছেন রতন মিয়া, কুমিল্লার আবুল হোসেন, হুমায়ন মেম্বার, লক্ষ্মীপুরের রিপন হোসেন ওরফে রিংকু, ইব্রাহিম মজুমদার, নোয়াখালীর রফিক, হাসান ওরফে রুশো হাসান, শেরপুরের মাহবুব আলম, গোপালগঞ্জের টুটুল হোসেন খান, ফেনীর সরোয়ার হোসেন, চাঁদপুরের সবুজ মিজি ও পশ্চিম মদনা এলাকার কবির জমাদার প্রমুখ।

রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান মাদক বিপণন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত জেনেভা ক্যাম্পের মাদক গডফাদার ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসান আছেন শীর্ষ ১০ তালিকার এক নম্বরে। অনুসন্ধানে তার তিনটি ঠিকানা পাওয়া যায়। প্রথম ঠিকানাটি জেনেভা ক্যাম্পের বি-ব্লকের ১৬২ নম্বর বাসা। দ্বিতীয় ঠিকানা সভারের মাদ্রাসা রোডের জাদুরচর ঈশিকা ভবন। তার তৃতীয় ঠিকানা হচ্ছে আশুলিয়া ব্যারন বাসস্ট্যান্ড এলাকার ১০/এ নম্বর প্লটের ছয়তলা বাড়ি। সূত্র জানায়, ইসতিয়াক দেশে থাকেন কম। বছরের বেশির ভাগ সময় তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখানে তিনি সেকেন্ড হোম করেছেন। মালয়েশিয়ায় তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পের প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে ইসতিয়াক পরিচিত। তালিকার ২ নম্বরে ছিলেন মোস্ট ওয়ানটেড মাদক ব্যবসায়ী নাদিম ওরফে পশ্চিম। তিনি ক্রসফায়ারে নিহত হন।

কক্সবাজারের টেকনাফে এমন গডফাদারের সংখ্যাই বেশি। আত্মগোপনে আছেন তাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদার হলেন- সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, জালিয়াডপাড়ার জাফর আলম প্রকাশ টিটি জাফর, টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ও তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাহান মিয়া, বাহারছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও তার ভাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন, উখিয়া গুয়ালিয়ার ইউপি সদস্য মোস্তাক আহমদ, নুরুল হক ভুট্টো, কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার শাজাহান আনসারী, তার ভাই কাশেম আনসারী, একই এলাকার আবুল কালাম ও তার ভাই বশির আহমদসহ অন্তত ২০ জন। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও রয়েছে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর