সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

একটি অধ্যায়ের অবসান

নিজস্ব প্রতিবেদক

একটি অধ্যায়ের অবসান

সামরিক শাসক হিসেবে যাত্রা শুরু করা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের অবসান হলো। তিনি একমাত্র সামরিক আইন প্রশাসক যার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০  সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি প্রথম গৃহবন্দী ছিলেন। তারপর তাকে কারাগারে নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারাগার থেকেই রংপুরের পাঁচটি আসনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে শপথ নেন। এরশাদের সংসদ নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। রংপুরের মানুষ তাকে সব সময় সমর্থন দিয়েছে। ’৯০-সালের পর থেকে জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচিত অবস্থানে ছিলেন এইচ এম এরশাদ। তার সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই সবসময় তৎপর ছিল। তাকে ঘিরে ভিন্নমাত্রা পায় জোট-মহাজোটের রাজনীতি। তাকে জোটে পেতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিযোগিতায় নামে। কার্যত, গত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের জোটের রাজনীতিতে এরশাদ ছিলেন ফ্যাক্টর। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও তার বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন একাধিকবার। কিন্তু ’৯৬ সাল থেকে তার সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে। এরশাদের পক্ষ থেকে তখন সমঝোতা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। ২০০৬ সালে রাজধানীর পল্টনে ১৪ দলীয় জোটের জনসভায় এরশাদ যোগ দেওয়ার পর মহাজোট তৈরি হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এরশাদ মহাজোটের হয়ে অংশ নেন। ২০১৪ সালে রাজনীতির কঠিনতম সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার দল আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের সঙ্গে থেকেই সরকারে যোগ দেন। এরপর তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনকালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ সেনাপতি থাকা অবস্থায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন তিনি। ১৯৮৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন। সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে পেয়েছিলেন ‘পল্লীবন্ধু’ উপাধি। টানা ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এর পর ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেন এরশাদ। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরই গ্রেফতার হয়ে জেলে যান তিনি। তবে ’৯০-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এরশাদ।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০ আসনে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮ আসনে জয়  পেয়ে সরকার গঠন করে। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনেই সর্বাধিকসংখ্যক (৪৯ জন) প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ৫ দলের সঙ্গে জোট করে  ভোট করতে চেয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে ৪২টি আসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় জোটের শরিকদের। কিন্তু ৫ দল বেশি আসন দাবি করায় শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নির্বাচন করা হয়নি। রাষ্ট্রপতি এরশাদকে মূল প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে জোটগুলো গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর জোট গঠনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানাটানি। ১৯৯১-এর বিএনপির শাসনকালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন একটি জোট গড়ে ওঠে। ওই জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টিও  যোগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে জাসদ (রব) ও জাতীয় পার্টি সরকারে যোগ দেয়। তবে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার থেকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে যায়। পরে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোট করে। বিএনপি-জাতীয় পার্টি ছাড়া চার দলের বাকি দল দুটি হচ্ছে- জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। তখন জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ বিএনপির  নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে যায়। চারদলীয় জোট সরকারের  মেয়াদের শেষ দিকে রাজনীতিতে নতুন  মেরুকরণ হয়। তখনো এরশাদকে পক্ষে নিয়ে দুই প্রধান দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নানা চেষ্টা চালায়। চারদলীয় জোটের বিপরীতে গঠিত হওয়া ৮ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়ে ১১-দলীয় জোটে পরিণত করে। ওই জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বর্তমানের ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণফোরামের ড. কামাল হোসেন। ১১ দল পরে ১৪ দল হয়ে মহাজোটে রূপ লাভ করে। ওই জোটে যোগ দেন এরশাদ। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে বিএনপি এরশাদকে জোটে ভেড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেও একপর্যায়ে এরশাদ পল্টনের জনসভার মঞ্চে উপস্থিত হয়ে মহাজোটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ওই মঞ্চে বিকল্পধারার বি চৌধুরী, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমেদও  যোগ  দেন। কিন্তু নির্বাচন করেন পৃথকভাবে। জোটের রাজনীতির সুফল বুঝতে  পেরে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে এবং সরকার গঠনে সক্ষম হয়। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো। জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সংসদে বিরোধী দল হয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হন রওশন এরশাদ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হন এরশাদ। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে পাশে পেতে নানা কৌশল নেয়। অন্যদিকে বিএনপি থেকেও এরশাদকে পাশে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। শেষমেশ আওয়ামী লীগের  নেতৃত্বাধীন মহাজোটেই যোগ দেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে আবার টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনের পরই জাতীয় পার্টি সরকারে থাকবে না বিরোধী দলে থাকবে এ নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। অবশেষে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর