সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
ডিসিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকারি সব সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসকদের (ডিসি)। একই সঙ্গে দেশে চলমান উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে কাজের গতি আরও বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখাটা জরুরি। আর এটা মাথায় রেখেই আপনাদের কাজ করে যেতে হবে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে জেলা প্রশাসকদের পাঁচ দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৩১ দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৬৪ জেলার ডিসি ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মুখ্য সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসাইন, শেরপুর জেলা প্রশাসক আনারকলি মাহবুব এবং টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা  নিয়ে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করাই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটা শেষ হয়ে গেছে। কাজেই সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবাইকে সক্রিয় রেখে সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে এবং সমাজের সবাইকে যুক্ত করে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে প্রতিরোধ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাদক একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়, সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। মাদকের ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতিসহ নানা ধরনের যে অসামাজিক কার্যক্রম সেগুলো আমাদের দূর করতে হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে স্পষ্ট কথা হচ্ছে- ঘুষ যে নেবে সে শুধু অপরাধী না, যে ঘুষ দেবে সেও সমানভাবে অপরাধী। বরং যে ঘুষ দেবে সেই বেশি অপরাধী। এই কথাটা মাথায় রেখে কাজ করলে আমরা এর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারব। শেখ হাসিনা দেশের সর্বস্তরে ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের উদ্দেশে বলেন, সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ডিসিদের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, দৈনন্দিন প্রয়োজনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে জেলার সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক কিন্তু সম্পূর্ণ কমিউনিটির। এটা সীমিত আকারেই থাকবে। রেফারেন্স সিস্টেম থাকবে। সেখান থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে হাসপাতালগুলোতে পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, এই হাসপাতালগুলোতে আমাদের সমস্যা হয় ডাক্তার থাকে না, সার্জন থাকে না, অ্যানেসথেসিস্ট থাকে না। এখানে একটা সমস্যা আছে উপজেলায়, তাদের বাসস্থানের অভাব। আমরা বাসস্থান নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছি। ডাক্তারদের সেখানে রাখার ব্যবস্থাটা কীভাবে  কোন প্রক্রিয়ায় করা যায় সেটা আমরা চিন্তাভাবনা করছি। আমরা অনেক কিছুই করছি, কিন্তু কোনোমতেই ডাক্তারদের সেখানে রাখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা একটা বিরাট সমস্যা। যারা ওখানে বদলি হবে, থাকবে না আমার মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দরকার হলে চাকরি থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কঠোর ব্যবস্থাটা না নিলে আমরা মানুষের সেবা দিতে পারব না। শেখ হাসিনা ডিসিদের উদ্দেশে বলেন, সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলি অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’ তার সরকার এই লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। তিনি ডিসিদের বলেন, আপনাদের চাকরি তো দীর্ঘকালীন, আর আমাদের চাকরি স্বল্প মেয়াদের। পাঁচ বছরের জন্য আমরা নির্বাচিত হয়েছি। কাজেই এই পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের দেশটাকে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে চাই। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা বাজেট দিয়েছি বা পরিকল্পনা নিয়েছি বা নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিয়েছি। সেই লক্ষ্যটা হলো বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমাদের ২১ ভাগ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে এবং আমি মনে করি, আমরা যদি আরেকটু প্রচেষ্টা নিই- আমাদের হাতে এখনো যে সময়টা রয়েছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২/৩ ভাগ কমাতে পারব। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। তিনি বলেন, এই দেশের মানুষ যেন মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে পারে- সে ব্যবস্থাটাই করতে চায় তার সরকার। সরকারপ্রধান বলেন, জেলা প্রশাসকরা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করতে হবে। দফতরগুলোর বিদ্যমান সেবা তৃণমূলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্যমেলা, সেবা সপ্তাহ পালনসহ ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের উদ্দেশে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, যৌতুক, ইভ টিজিং এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আপনাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে র সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংস্কৃতিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসিদের বলেছেন, শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য-পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ, বাজার-ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ, ভোক্তা-অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে। পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে হবে। চিত্তবিনোদন ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুবিধার্থে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, হিজড়া, বেদে ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা, জলাধার সংরক্ষণের জন্য খাল খনন ও পুকুর খনন, পরিকল্পিত সড়ক, নগরায়ণ ও বনায়ন নিশ্চিত করা; গৃহহীন, ভূমিহীন ও ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন তিনি। এদিকে সম্মেলনের উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বল্প সময়ের জন্য মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি মিলিয়ে অন্তত ১২ জন বক্তব্য রাখেন। অন্যদিকে বিকালে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়বিষয়ক কার্য অধিবেশন। এসব অধিবেশনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালগুলোর মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা ডিসিদের বক্তব্য শুনেন এবং তাদের দিকনির্দেশনা দেন।

সর্বশেষ খবর