বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশ কি অসম্ভব?

মাহবুব আহমেদ

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উচ্চ মাত্রার স্থূল জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ৬ এর ঘরে আটকে থাকার পর প্রবৃদ্ধির হার তিন/চার বছর আগেই ৭ এর ঘরে পড়েছে। চলতি অর্থ বছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৩ শতাংশ হবে বলে ইতিমধ্যে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে সরকার দাবিকৃত প্রবৃদ্ধির সমর্থন পাওয়া যায় না। তাদের মতে এত উচ্চ মাত্রার প্রবৃদ্ধি বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশের স্থূল জাতীয় আয় (জিডিপি) সমীকরণের মূল চারটি উপাদান- ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় ও আমদানির রপ্তানির পার্থক্য কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। উপাত্তে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ এ পাবলিক এবং প্রাইভেট বিনিয়োগে দুটোই বেড়েছে। মোট অঙ্কও বেড়েছে, বর্ধিত জিডিপির অংশ হিসেবেও বেড়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ২০১৭ সালে ছিল জিডিপির ২৩.১০ শতাংশ, তা ২০১৮-তে হয়েছে ২৩.২৬ শতাংশ এবং ২০১৯-এ হবে ২৩.৪০ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ ২০১৭-তে ছিল জিডিপির ৭.৪১ শতাংশ, ২০১৮ সালে হয়েছে ৭.৯৭ শতাংশ এবং ২০১৯-এ তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৮.১৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে মোট ঋণ প্রবাহ ছিল ৮ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে তারা পারিবারিক বা স্থানীয় সঞ্চয় ব্যবহার করেও উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। বিনিয়োগ বিবেচনার ক্ষেত্রে এসব বিনিয়োগ হিসাবভুক্ত না হলেও উৎপাদন পর্যায়ে হিসেবে এসেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মেগা প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোয় বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এসব বিশাল ব্যয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া রাখতে বাধ্য।

মাথাপিছু আয় যেহেতু বেড়েছে ভোগও স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে। বিভিন্ন উৎসব পার্বণেও ভোগ তাড়িত ব্যয় চোখে পড়ার মতো। স্বল্পকালীন বিরতির পর রেমিট্যান্স উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, চলতি আয় বর্ষে একই সময়ে এ অঙ্ক ছিল ১০.৭ বিলিয়ন ডলার। এ বাড়তি ১.২ বিলিয়ন ডলারের একটা বড় অংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। রপ্তানিও বেড়েছে। বর্তমান বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১২.৫৭ শতাংশ, পূর্ববর্তী বছরে এ হার ছিল ৬.৩৩%।

ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় ও রপ্তানি এগুলো যদি নাও বাড়ে তবুও একটি বিকাশমান অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব- Incremental Capital Output Ratio (ICOR) হ্রাস পাওয়ার মাধ্যমে, অর্থাৎ দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। বাংলাদেশে ICOR ৩.৯৭ হতে ৩.৮৮-এ নেমেছে। এর ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ দক্ষতা বৃদ্ধিজনিত কারণে অধিকতর দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করতে পারে । এ রকম প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে, দেশের প্রযুক্তি খাতে এমন কিইবা ঘটেছে যে, দক্ষতা পারদর্শিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ICOR কমে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে? এ কথা সুস্পষ্ট যে, গত দশ বছর ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নিরন্তর কাজ চলছে। উন্নয়ন কৌশলে উৎপাদনের উপকরণের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে দক্ষতা পারদর্শিতা নির্ভর উন্নয়ন কৌশলে জোর দেওয়া হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে অর্থ বিভাগ কর্তৃক চলমান একটি প্রকল্পের সহায়তায় ইতিমধ্যে স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেডে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ চলছে পুরোদমে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনলাইন সেবাও চলছে উল্লেখযোগ্যভাবে। অর্থনীতিতে এসবের ধনাত্মক প্রভাব তো পড়তেই পারে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমাদের দেশের কারও কারও সংশয় থাকলেও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোরূপ সংশয় নেই। এডিবি এর এপ্রিল, ২০১৯ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ফ্যাক্ট শিট’-এ ২০১৮ জুনে সমাপ্ত অর্থ বর্ষে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলিত হার দেখানো হয়েছে ৭.৯ শতাংশ। চূড়ান্ত হিসেবে তা ৮ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে অতীত অভিজ্ঞতায় বলা যায়। লেখক : সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।

সর্বশেষ খবর