রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বরগুনায় সুনামের যত দুর্নাম

মাদক চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজদের নিয়ন্ত্রণ এমপিপুত্রের হাতে

আরাফাত মুন্না, বরগুনা থেকে ফিরে

বরগুনায় সুনামের যত দুর্নাম

ওপরের ছবিতে সুনামের সঙ্গে জনসহ অন্যরা। নিচে আলোচিত জনের সঙ্গে নয়ন বন্ড -সংগৃহীত

একসময় শান্তির জনপদ ছিল দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনা। শিল্প-কারখানা বা বহুতল ভবনের চাকচিক্য তুলনামূলক কম থাকলেও সামাজিক পরিবেশ ছিল সৌহার্দ্যে ভরা। কিন্তু সেই শান্তি-সৌহার্দ্যরে শহরে এখন শুধুই ভয়। গত কয়েক বছরে ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়েছে এ শহর। প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পর বরগুনার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকরাও আলোচনায় এসেছে। জানা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথই সব অপরাধীর নিয়ন্ত্রক। বরগুনায় মাদক ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, এমনকি ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণও সুনাম দেবনাথের হাতে।

সুনামের দুই সহযোগী মঞ্জুরুল আলম জন ও শাওন তালুকদার নিয়ন্ত্রণ করেন কিশোর গ্যাং। জন পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র রাইসুল আলম রিপনের ছেলে এবং শাওন সুনাম দেবনাথের স্ত্রীর চাচাতো ভাই। শাওনের বিরুদ্ধে মাদকের বেশ কয়েকটি মামলা থাকলেও জনের বিরুদ্ধে মাদকের কোনো মামলা নেই। অথচ পৌর মার্কেটের তৃতীয় তলায় বসে মঞ্জুরুল আলম জন ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের পর অফিস বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন সুনাম দেবনাথের বাঁ হাত বলে পরিচিত এই জন। বরগুনার রাজনীতিক, পেশাজীবী ও স্থানীয় সাধারণ মানুষের বক্তব্যে এসব তথ্যই উঠে এসেছে। এ বিষয়ে কথা বলতে সুনাম দেবনাথের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করে এবং এসএমএস দিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বরগুনা শহরের অধিকাংশ মানুষ সুনাম দেবনাথের এসব অপকর্মের কথা জানলেও তারা প্রকাশ্যে ভয়ে মুখ খোলেন না। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের পদস্থ নেতারা এসবের বিরুদ্ধে গোপনে কথা বললেও স্থানীয় এমপি ও তার ছেলের ভয়ে সরাসরি বা স্পষ্টভাবে কথা বলতে সাহস পান না। পেশায় আইনজীবী হলেও সুনাম দেবনাথ আদালতে যান না। তার একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সুনাম সারা দিন নিজের স্মার্ট ফোনে ‘তিন পাত্তি’ গেম খেলেন। শহরের বাবার (সংসদ সদস্যের) কার্যালয়ে বসে সারা দিন নিজের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের নিয়েই সময় কাটান তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনা জেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ তার পছন্দের হাতে গোনা কতিপয় নেতা-কর্মীকে নিয়ে বরগুনায় অন্য রকম এক রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, কয়েকজন নেতাকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট আকারে বরগুনার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন সুনাম দেবনাথ। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে বা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলে তাকে চরম মাশুল দিতে হয়। সুনাম দেবনাথের এসব অপকর্মের বিষয়ে গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ তুলেছিলেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবায়াত আদনান অনিক। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুনামের অপকর্মের বিষয়ে জানলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। বরগুনা ছাত্রলীগের সভাপতি অনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বরগুনায় চিহ্নিত সব মাদক ব্যবসায়ীর নেতৃত্ব দেন খোদ এমপির ছেলে সুনাম দেবনাথ। কৌশলে বরগুনার অধিকাংশ তরুণকে তিনি মাদক সেবন ও মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে টানছেন। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকের পদ ও পদবি ব্যবহার করে মাদক বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক তিনি। বরগুনার অধিকাংশ মাদকসেবী এবং চিহ্নিত সব মাদক ব্যবসায়ী তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। তিনি বলেন, বরগুনার শীর্ষ সন্ত্রাসী অভিজিৎ তালুকদার ওরফে অভি এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের শ্যালক, যার নামে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ ১৫ থেকে ১৬টি মামলা রয়েছে। একের পর এক ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করেও অভি পার পেয়ে যান সুনাম দেবনাথের সহযোগিতায়। মাদক সিন্ডিকেটের যুবরাজ এই সুনাম দেবনাথের একজন মাদক সরবরাহকারী আমতলীর হানিফ মুসল্লী ১ হাজার ৯০০ বোতল ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। অভি জানান, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাল পে-অর্ডার কেলেঙ্কারি করে গণমাধ্যমে উঠে আসে বরগুনার তৎকালীন পিআইও ইসরাফিলের নাম। তিনি সুনাম দেবনাথের অন্যতম প্রধান ফেনসিডিল পার্টনার। তাকে টেন্ডার-সংক্রান্ত সব ধরনের অবৈধ সহযোগিতা দিয়ে আসতেন এই ইসরাফিল।

নয়ন বন্ডের ঢাল : স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, এলাকায় নিজের ক্ষমতার দাপট টিকিয়ে রাখতে নয়ন বন্ডদের মতো সন্ত্রাসীদের তৈরি করেন এমপিপুত্র সুনাম। নয়ন বন্ডের সব কুকর্মের ঢাল হয়েও তিনি দাঁড়াতেন। নয়ন বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করত না। বেশি চাপাচাপি করলে সুনাম দেবনাথের কাছে যাওয়ার পরামর্শ পুলিশই দিত বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অভিযোগ অনুযায়ী, সুনাম দেবনাথের মাদক কারবার দেখভালের মূল দায়িত্বে ছিল নয়ন বন্ড। ফলে আট মামলার আসামি নয়ন বন্ডকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সময় শেল্টার দিয়ে আসছিলেন সুনাম দেবনাথ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন আইনজীবী জানান, নয়ন বন্ড ছিল এমপিপুত্রের প্রধান হাতিয়ার। এমপিপুত্রের কথায় নয়ন বন্ড সব কাজই করত। তাই এই নয়ন বন্ডের সব অপরাধের ঢাল হিসেবে দাঁড়াতেন সুনাম দেবনাথ। তিনি বলেন, গত বছর নয়ন বন্ড রামদা নিয়ে বরগুনা পৌরসভার নয় নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ফারুকের ওপর হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এ সময় তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলেও সুনাম দেবনাথের হস্তক্ষেপে এ ঘটনায় কোনো মামলাই দায়ের হয়নি। এ ছাড়া সদর উপজেলার বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইলিয়াস হোসেনের ছেলের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী। বিষয়টি নিয়ে ইলিয়াস চেয়ারম্যান থানায় মামলা করতে গেলে ওই মামলাও নেওয়া হয়নি। তিনি মামলা গ্রহণের জন্য চাপাচাপি করলে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাকে সুনাম দেবনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তবে এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বরগুনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমন কথা কেউ বলতে পারবে না যে কারও অভিযোগ গ্রহণ করিনি। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সব সময় কাজ করে যাচ্ছি।’

‘পুলিশ নজরদারিতে রেখেছে’ অভিযোগ মিন্নির পরিবারের : বরগুনা প্রতিনিধি জানান, গতকাল বেলা ১১টায় বরগুনায় কারাগারে মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে যান তার পরিবারের সদস্যরা। তারা অভিযোগ করেন, দুই-তিনজন সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্য তাদের চারপাশে অবস্থান করে মিন্নির সঙ্গে তাদের স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দিচ্ছিলেন না। মিন্নির মা জিনাত জাহান মনি অভিযোগ করেন, তিনি যখন তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন গোয়েন্দা পুলিশ তাকে সরে যেতে বলেন। এতে তিনি প্রতিবাদ জানান। এ ব্যাপারে কারা সুপারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়মিত সাদা পোশাকের পুলিশ এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকে। মিন্নির সঙ্গে দেখা করার সময় এসবির লোকজন উপস্থিত থাকার সত্যতা স্বীকার করেন তিনি। মিন্নির দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের বিষয়ে কারা সুপার বলেন, এ ব্যাপারে কারা আইন অনুসারে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

সর্বশেষ খবর