রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছেলেধরা গুজব হামলা চলছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছেলেধরা গুজব আতঙ্ক এখনো কাটেনি। দেশের অন্যতম বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এমন একটি অপপ্রচার ও গুজব দেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় অপরিচিত মানুষ দেখলে অনেকটা মারমুখী ভঙ্গিতেই স্থানীয় বাসিন্দারা পরিচয় জিজ্ঞেস করছেন। যথাযথ পরিচয় দেওয়ার পরও গ্রামের মানুষজন ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছেন না। স্থানীয় কেউ যতক্ষণ না অপরিচিত ব্যক্তিকে তার পরিচিত বলে আশ্বস্ত করছে, ততক্ষণ সন্দেহ কাটছে না এলাকাবাসীর।

এমন গুজবের ওপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে গণপিটুনিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত ১৩ দিনে ১২ জন নিহত ও আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬৬ জন। এতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এমন ভয়ঙ্কর গুজব দমনে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। মাঠেও তৎপর রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা জিনাত বলেন, আমাদের মহল্লায়ও ছেলেধরা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ কেউ তাদের সন্তানদের বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে গণপিটুনির খবরে আমাদের মধ্যে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাসিন্দা তাসনিমা আক্তার বলেন, উপজেলাজুড়ে ছেলেধরা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ আতঙ্কে আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যেতে দিচ্ছি না। এ ছাড়াও সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার কথা বললে তারাও ভয়ে যেতে চাচ্ছে না।

হাবিবুর রহমান নামে এক প্রাইমারি শিক্ষক জানান, ছেলেধরা আতঙ্কে গত সপ্তাহে তাদের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা কম ছিল। পরবর্তীতে স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করায় এ সপ্তাহে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এমন আতঙ্ক ও গুজব রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর। র‌্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে দেশের প্রতিটি ইউনিটে বার্তা পাঠানো হয়েছে। যারা এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ছেলেধরা কাউকে সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ছেলেধরা গুজব রোধে পুলিশ কঠোরভাবে কাজ করছে। ইতিমধ্যে দেশের সব ইউনিটে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ছেলেধরার নামে যত গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি একটি ফৌজদারি অপরাধ। এ অপরাধের তদন্ত চলছে। আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ছেলেধরা বিষয়ে সন্দেহ হলে ‘৯৯৯’-এ ফোন দিয়ে পুলিশের সহায়তা নিন।

ছেলেধরা গুজবের শিকার ৯ জন : সারা দেশে চলছে ছেলেধরা গুজব। এই সন্দেহে টাঙ্গাইলের চার উপজেলায় ৯ জন গণপিটুনি ও হামলার শিকার হয়েছেন। তবে তাদের কাউকেই ছেলেধরার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের ঘটনা সচেতনতার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। পুলিশ গণধোলাইকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন এবং গুজব ঠেকাতে চালাচ্ছে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা। জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে ২১ জুলাই গণধোলাই দেওয়া হয়। উপজেলার গালা ইউনিয়নের কান্দিলা বাজারে আকাশ নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করা হয়। সে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। অপরদিকে টাঙ্গাইল পৌরসভার শান্তিকুঞ্জ মোড়ে এক যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেন। তাদের দুজনকেই টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টাঙ্গাইল সদর থানার ওসি মীর মোশারফ হোসেন বলেন, একজন মানসিক প্রতিবন্ধী, আরেকজন ভবঘুরে। দুজনেরই কেউই ছেলেধরার সঙ্গে জড়িত নয়। কালিহাতী উপজেলার সয়া হাটে গত ২১ জুলাই মাছ ধরার জাল কিনতে এসে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন মিনু মিয়া (৩০) নামের এক ভ্যান চালক। তিনি ভূঞাপুর উপজেলার বন্যাকবলিত টেপিবাড়ী গ্রামের মৃত কোরবান আলীর ছেলে। তিনি বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনায় মিনুর ভাই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কালিহাতী থানার ওসি হাসান আল মামুন।

এদিকে কালিহাতীর বলদী গ্রামে ২৩ জুলাই বিকালে শামীম মিয়া (৪০) নামের ধানকাটার এক শ্রমিককে ছেলেধরা সন্দেহে এলাকাবাসী আটকে রেখে পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর থানার কাউয়াকোলা ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে। কালিহাতীর থানার এসআই ওহাব মিয়া বলেন, শামীম কানে কম শোনেন। তাকে সেই রাতে পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভূঞাপুরে ছেলেধরা সন্দেহে শিউলি আক্তার (৩০) নামের এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। ২৩ জুলাই বিকালে উপজেলার মাটিকাটা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শিউলি আক্তার ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার চেচুয়া গ্রামের আমির উদ্দিনের মেয়ে। ভূঞাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ রাশেদুল ইসলাম বলেন, মানসিকভাবে অসুস্থ ওই নারী বাড়ি থেকে বেশ কিছুদিন আগে চলে যান। পথে তার সঙ্গে থাকা ঝোলা দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। ঝোলাটি চেক করার সময় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরে জনতা কিলঘুষি দেন। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার এবং পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। ওসি আরও জানান, মঙ্গলবার রাতে ঘাটাইলের পশ্চিম সিংগুরিয়া এলাকার শাহজাহান আলীর ছেলে কাভার্ট ভ্যানচালক সোহরাব আলী বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় হোমেরা নামক এক মহিলা ছেলেধরা বলে চিৎকার দিলে লোকজন তাকে হামলা করেন। মার থেকে বাঁচতে সোহরাব আলী পাশের পুকুরে লাফ দেন। খবর পেয়ে আমরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করি। তবে স্থানীয়দের ধারণা পরকীয়া সংক্রান্ত বিষয় এখানে রয়েছে। সবশেষে সখিপুরের কুতুবপুর থেকে ২৪ জুলাই তিন নারীকে গণধোলাই না দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকাবাসী। ওসি আমির হোসেন বলেন, তাদের মধ্যে কবির হোসেনের স্ত্রী আলপনা (৩২) এবং জহুরুল ইসলামের স্ত্রী তানিয়ার (৩০) বাড়ি ময়মসিংহের ভালুকার উথুরায়। তারা কবিরাজ দেখানোর জন্য এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অপরজন খাদিজা আক্তার (৩৫) একেক সময় একেক পরিচয় বলায় তাকে আদালতে চালান করা হয়েছে। তবে ছেলেধরার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর