বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য খাতে আবার মিঠু সিন্ডিকেট

যন্ত্রপাতি কেনার নামে ভুয়া ভাউচারে ২০ কোটি টাকা লোপাট, রংপুর মেডিকেল পরিচালক ওএসডি, সারা দেশে আরও ২০০ কোটি লুটের আশঙ্কা

মাহবুব মমতাজী

স্বাস্থ্য খাতে আবার মিঠু সিন্ডিকেট

স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেটের বেপরোয়া দুর্নীতি চলছে তো চলছেই। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে সম্প্রতি তারা যা করেছে তা নির্লজ্জ লুণ্ঠন ছাড়া কিছুই নয়। অভিযোগ রয়েছে, যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ভুয়া ভাউচারে জাল-জালিয়াতি করে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবদুল গনিকে ‘তিরস্কারস্বরূপ’ ১৪ জুলাই অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করা হয়েছে। জানা যায়, শুধু রংপুরেই নয়, সারা দেশে এভাবে অন্তত ২০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। দরপত্রের চাহিদাপত্র তৈরি, কার্যাদেশ দেওয়া, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনা এবং তা বুঝে নেওয়ার প্রতিটি জায়গায় চরম অসংগতি ধরা পড়েছে। হাসপাতালের জন্য একাধিক যন্ত্রপাতি জাপান, ইতালি, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এনে সরবরাহের কথা হয়। কিন্তু তা করেনি ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। অথচ এসবের বিপরীতে বিলের ফাইলে জাল করে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ২০ কোটি টাকার চেক তুলে নেওয়া হয়। কেলেঙ্কারি জানাজানি হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অফিসে যোগাযোগ করে আরও ৭ কোটি টাকার চেক আটকে দেয়। আর এই চেকের টাকা আটকে দেওয়ার পরই ওএসডি করা হয় হাসপাতাল পরিচালক ডা. মো. আবদুল গনিকে। শুধু রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই নয়, সারা দেশে গত জুন ক্লোজিংয়ে অন্তত ২০০ কোটি টাকার বিল হাতিয়ে নিয়েছে একই ঠিকাদারি সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই অর্থ পরিশোধের বিল স্বাক্ষরে সময় লেগেছে মাত্র চার দিন। ‘বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কো.’ নাম ব্যবহার করে পুরো ঠিকাদারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু নামে এক ব্যবসায়ী। আর রংপুরে তাকে সহায়তা করেন হাসপাতালের কর্মচারীদের সরদার নোমান। রংপুরে মিঠু ও নোমানের নেতৃত্বে ‘চার খলিফা’ নামে বিশাল একটি ঠিকাদারি সিন্ডিকেট রয়েছে। এ সিন্ডিকেটটি মালামাল সরবরাহ ছাড়াও রংপুর শহরে অবস্থিত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরকারি ওষুধও সরবরাহ করে।

সূত্র জানান, চলতি বছর জুনের ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০ তারিখে ওই বিলের ফাইলে স্বাক্ষর করা হয়। এরপর সেগুলোর চেক ইস্যু করা হয়। আর জুন ক্লোজিংয়ে কেনাকাটার জন্য বাজেটের নির্ধারিত টাকা ফেরত যাওয়ার আগে এসব করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ঠিকাদার মিঠুর যোগসাজশে। নেপথ্যে একটি পেশাজীবী সংগঠনের কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। গত ২৭ জুন সংসদীয় কমিটির এক সভায় যোগ দিতে ঢাকায় ছিলেন হাসপাতাল পরিচালক ডা. মো. আবদুল গনি। ২৮ জুন রংপুরে ফিরে তিনি অসুস্থ হলে বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। তখন পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন উপপরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ। ডা. গনি ৯ জুলাই কাজে যোগদান করেন। যোগদানের পরই তার বিরুদ্ধে হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ ৬৩ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনায় নির্দেশ অমান্যের অভিযোগ আনে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ১৪ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে ওএসডি করা হয়। জানতে চাইলে ডা. আবদুল গনি জানান, যে সময় বিলগুলো পাস হয়েছে সে সময় তিনি অসুস্থতাবশত ছুটিতে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে চার দিনে বিলের ফাইলসহ নানা ফাইল স্বাক্ষর করেন উপপরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ। তবে ডা. সুলতান আহমেদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মালামাল সরবরাহ না করে বিল পাস করিয়ে নেওয়া বিষয়ে অনেক কথা আছে। কথাগুলো ফোনে বলা যাবে না। সামনাসামনি বিস্তারিত বলা যাবে।

বিল জালিয়াতির বিষয়ে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে (এজি) যোগাযোগ করা হলে এখানকার কর্মকর্তারা জানান, রংপুরের বিল-ভাউচারসংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় অফিসেই রয়েছে। ওসব তাদের কাছে নেই। গত ৭ মে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শামীমা নাসরীনের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ডা. আবদুল গনিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাসিমা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডা. গনিকে ওএসডি করা হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। তিনি বলেন, ‘রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মালামাল সরবরাহের বিলের জাল-জালিয়াতি বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ জানা যায়, জালিয়াতি করা বিলগুলোতে পারস্পরিক যোগসাজশে যন্ত্রপাতির মূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে লেখা হয়েছে। সেখানকার সরকারি অর্থ লুটের পথ সহজ করতে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র উন্মুক্তকরণ, বাজারদর যাচাই-বাছাই, সার্ভে কমিটিসহ প্রতিটি কমিটিতে কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের তিনজন শিক্ষককে রাখা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর