শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের অভিযোগের জবাবে ‘জিরো টলারেন্স’র অঙ্গীকার

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে বাংলাদেশ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকা-, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শতাধিক অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নির্যাতনবিরোধী কমিটি।

সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় গত দুই দিনব্যাপী বৈঠকে উত্থাপিত এসব প্রশ্নের জবাবে নির্যাতন ও মানবাধিকার প্রশ্নে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার করেছে সরকার। আগামী মঙ্গলবার কমিটির উন্মুক্ত বৈঠক হবে। আগামী ৯ আগস্ট জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির বর্তমান অধিবেশন শেষ হলে বাংলাদেশ নিয়ে পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা হবে। এ অধিবেশনে আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশের পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নির্যাতনবিরোধী কমিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হলেও বিভিন্ন আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কমিটি অভিযোগ পেয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত নির্যাতন চালায় এবং এসব অভিযোগের বেশিরভাগেরই কোনো কার্যকর তদন্ত হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না এবং তারা দায়মুক্তি পেয়ে থাকে। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষজ্ঞরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বিচারকরা যেন রাজনৈতিক চাপে না থাকেন এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী করার ওপরও জোর দেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। বৈঠকে জাতিসংঘ কমিটির চেয়ারপারসন জেনস মদভিগ বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোকে সুরক্ষার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশের কারাগারে যেসব বন্দী আছেন, তাদের ৮১ শতাংশই দি ত আসামি নয়। বিচারের আগেই তাদের কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। এটাকে ‘ভয়াবহ’ মন্তব্য করে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। তারা এ ধরনের বন্দীর সংখ্যা কমাতে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। আদালতের জামিন ও খালাসের আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ওপরও জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বুধবার এ বিষয়ে কমিটিতে দ্বিতীয় দিনের মতো আলোচনা হয়। প্রথম দিনের বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের নির্যাতনবিরোধী নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মন্ত্রীর উপস্থাপনার পর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ইস্যুতে মতামত দেন এবং মন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। এ সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের ব্যাপারে জাতিসংঘকে প্রতিশ্রুতি দেন। এ জন্য জাতিসংঘের সনদের আলোকে বাংলাদেশ ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এ ছাড়া তিনি নির্যাতনবিরোধী জাতিসঙ্ঘ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান জাতিসংঘ কমিটিকে। আনিসুল হক পর্যালোচনা সভায় বিচারপতি এস কে সিনহা, আলোকচিত্র সাংবাদিক শহীদুল আলম, দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের নালিশ দিয়ে আলোচিত প্রিয়া সাহার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকার বিশেষ আদালত গঠন করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ বেশকিছু প্রকল্পের মাধ্যমে এই নির্দেশনা পালন করছে। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। মামলা জট কমাতে জাতীয় বিচারিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। আদালতের অবকাঠামো বাড়ানো হচ্ছে। আইনি সহায়তা সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ও জাতির চার নেতাকে কারাগারে হত্যার পর দায়মুক্তি এবং হত্যাকারীদের দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ইতিহাস তুলে ধরেন আনিসুল হক। এ ব্যাপারে বিশ্বের নীরবতার সমালোচনা করেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়।

পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, পুলিশ অস্ত্র ব্যবহার করলে পূর্ণ তদন্তের বিধান রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শেষ পদক্ষেপ হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। অনেক অপরাধী গ্রেফতারের চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয় বলে হত্যাকান্ডে র ঘটনা ঘটে। আনিসুল হক বলেন, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে কিনা তা যাচাই করতে পারেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি না দিলে আইনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। সরকারের একজন মন্ত্রীর মেয়ের জামাই হওয়া সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জে এইট মার্ডারের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ছাড় দেওয়া হয়নি। রিমান্ড সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কোনো ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হয়। অন্যথায় সত্য উঠে আসে না। রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ আনলে ম্যাজিস্ট্রেট মেডিকেল পরীক্ষার অনুমতি দিতে বাধ্য। তদন্তের জন্য রিমান্ড আবশ্যক। তবে এর অপব্যবহার যাতে না হয় সে জন্য সরকার সতর্ক রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারপূর্ব আটকের সময়সীমা বাংলাদেশের আইনে নির্ধারিত রয়েছে। অভিযোগ দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার বিধান নির্যাতনবিরোধী আইনে রয়েছে। তবে মামলা জটের কারণে অনেক সময় এই সময়সীমা অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে বিচারিক অডিট চালু করেছে বাংলাদেশ।

মন্ত্রী জানান, কারাগারের ধারণক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান কারাগার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধারণক্ষমতা ১৬ হাজার বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নয়টি কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে আরও বড় পরিসরে গাজীপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে। কারাগারে চিকিৎসা এবং নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে।

বিচারপতি এস কে সিনহা সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এস কে সিনহাকে দুর্নীতির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তারপরও শেখ হাসিনা সরকার সিনিয়র হিসেবে সিনহাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ব্যক্তিগত লাভের জন্য অনেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষার্থে তার চাকরির মেয়াদ থাকা পর্যন্ত সরকার অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা সীমা ছাড়িয়ে যায়। সিনহার দুর্নীতির ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে তার বর্ণনা দেন আইনমন্ত্রী। প্রিয়া সাহা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সরকার প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। অনেকেই তার বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করলেও আদালত তা নাকচ করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সংযত আচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পিরোজপুরে প্রিয়া সাহার জমি আদৌ কেড়ে নেওয়া হয়েছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলায় উসকানি দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে শহীদুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বলে জানান আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আদালতের নির্দেশনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা করে। বর্তমানে তিনি মুক্ত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যকর ভূমিকার জন্য সরকার সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানান আনিসুল হক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর