শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
সেই শশাঙ্ক ব্যানার্জির এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার-৩

যে কারণে নেহেরু-ইন্দিরা জাদুকরী নেতা বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা রেখেছিলেন

পীর হাবিবুর রহমান

যে কারণে নেহেরু-ইন্দিরা জাদুকরী নেতা বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা রেখেছিলেন

সেই সময়ের ঢাকাস্থ ভারতীয় উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যানার্জিকে আমি আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কি মনে করেন একাত্তর সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী না হয়ে তাঁর পিতা প-িত জওহরলাল নেহেরু থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতেন? তিনি জানতে চাইলেন, আপনার কী মনে হয়? আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে একাত্ম থাকা ভারতীয় কূটনীতিক যিনি আজ অবসরজীবনে বয়সে প্রবীণ, তাঁর সামনে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমার মনে হয়, ইন্দিরা গান্ধীর মতো তাঁর পিতা নেহেরু এভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন দিতেন না। স্মিত হেসে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আপনার ধারণা ভুল। নেহেরু একাত্তরে থাকলেও এই সমর্থন ও সহযোগিতা দিতেন। নেহেরু ’৬২ সালেই বুঝেছিলেন বলে শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ভারতীয় উপহাইকমিশনের উপপ্রধান সৌর্য্য কুমার দেখা করতে গেলে নেহেরু বলেছিলেন, শেখ মুজিব একজন জাদুকরী গণনেতা, যার দ্বারা সম্ভব তাঁর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্বের উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া। নেহেরু চতুর চীনের আক্রমণে পরাজিত হওয়ার শোক সইতে না পেরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও শেখ মুজিবের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থনদানের যে গাইডলাইন রেখে গিয়েছিলেন, তাঁর কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পিতার সেই নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র।

নেহেরু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি দেখে যেতে না পারলেও বিশ্বাস করতেন একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখেন। আর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর অবলোকন করেছেন, একজন দুর্ধর্ষ সাহসী নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তাঁর স্বাধীনতার সংগ্রামকে কীভাবে ত্বরান্বিত করে তাঁর দলকে জনপ্রিয় ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথে সফলভাবে ইতি টেনেছেন। পাকিস্তানি জেনারেলদের বা একনায়কদের ঘুম হারাম করে দিয়ে তিনি ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের নামে স্বাধীনতার সংগ্রামকে পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে দিতে সফল হয়েছেন। শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী একজন নেতা হিসেবে নেহেরুর কাছে যেমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন; তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছেও এই আদর্শের এক সাহসী, জনপ্রিয় বিস্ময়কর নেতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, তিনি বাগদাদ থেকে সত্তর সালে লন্ডন হাইকমিশনে আসার আগে ’৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে ইয়াহিয়া খানের আমলে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকেও ইন্দিরা গান্ধী সামগ্রিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠক করে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিকল্পনা করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংয়েরও পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁর প্রশিক্ষিত তরুণরা ভারত থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে আসবে এমন ব্যবস্থা পাকা করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন দেওয়ায় সেটি স্থগিত হয়ে যায়। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, সে সময় ভারতের কূটনৈতিক মহলে কৌতুকময় গল্প চালু ছিল যে, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রশংসা করে বলতেন- ব্যানার্জি তো ভালোই করছে। আর ভারতের জেনারেলরা মনে করতেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বোধহয় ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির প্রশংসা করছেন। আর তাই তাঁরা তাঁকে একের পর এক প্রমোশন দিতে থাকেন।

ব্যানার্জির ভাষায়, কৌশলগত বিষয় ছাড়াও ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগত পর্যায়েও বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর মমত্ব রাখতেন। বাঙালিদের ভালোবাসতেন এবং বাংলায় কথাও বলতেন। তিনি অক্সফোর্ডের পড়াশোনা শেষ না করে ফিরে গিয়ে পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে বাঙালি সংস্কৃতির প্রবাদপুরুষ, ভারতের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাকে নেহেরুও সম্মান করতেন এবং যিনি প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা নামটি রেখেছিলেন, তাঁর চরণে বসে পড়াশোনা করেছেন। যখন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর গণহত্যার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন তার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে এগিয়ে আসাই স্বাভাবিক ছিল। বাংলাদেশের সমর্থনে সামরিক বাহিনীকে সম্পৃক্ত করার বিবেচনা দৃশ্যপটে এসেছে অনেক পরে, প্রায় দ্বিতীয় চিন্তা হিসেবে। এ ছাড়া মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এই ঐতিহাসিক সত্য বিশ্বাস করতেন যে, বিপরীত দুটি জাতিকে শুধু একমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস একত্র করে রাখতে পারে না। যেখানে আদি বাঙালি ও আদি পাঞ্জাবি জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। যেখানে একটি দেশের দুটি বহুজাতিক গোষ্ঠীকে আলাদা করে দিতে পারে, ধর্ম দিয়ে তা এক করে রাখা যায় না। মানুষকে একটি একক রাজনৈতিক ইউনিটে বেঁধে রাখতে ধর্মের ব্যর্থতা আগেই নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল যখন ’৪৭ সালে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি পাকিস্তান চলে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। যদিও উপমহাদেশে মুসলিমদের ভূমি হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু একটি সাংস্কৃতিক দল হিসেবে ভারতীয় মুসলিমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতে থেকে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন। একাত্তর সালের গণহত্যা ছিল মুসলমানের ওপর মুসলমানের আঘাত। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি আরও বলেন, ভারতের গোয়েন্দা ব্যুরোতে কিংবদন্তিতুল্য ভোলানাথ মল্লিক, যিনি ভি এন মল্লিক নামে পরিচিত তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সিনিয়র উপদেষ্টাদের মধ্যে প্রথম ভারতের প্রতি পাকিস্তানের চিরস্থায়ী শত্রুতার নীতির বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, কাশ্মীরে আদিবাসী দখলদারিত্ব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ধ্বংস করতে সুদীর্ঘ ও টেকসই কর্মসূচির সূত্রপাত মাত্র।

পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জের ভিত্তি ছিল বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় চরমপন্থা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম। অন্যদিকে ভারতের জবাব ছিল স্থানীয় যার ভিত্তি গান্ধীজির অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আদর্শ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আধা-অফিশিয়াল নোটে গোয়েন্দাপ্রধান ভি এন মল্লিক লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তান যত দিন পর্যন্ত বর্তমান অবস্থায় থাকবে, তত দিন সে ভারতের আঞ্চলিক মর্যাদার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একমাত্র ভয়ঙ্কর হুমকি।’ তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে নয়াদিল্লির উচিত, পাকিস্তানের প্রশাসনিক, জাতিগত বিভক্তির কথা মাথায় রাখা।’ কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ পরামর্শ ভুলে যাননি। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বর হামলা ভি এন মল্লিকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। আর এ ঘটনা ভারতকে টেনে এনেছিল বাংলাদেশ সংকটে। এটি ভারতের জন্য শত্রুকে দুর্বল করে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। শত্রুর ঘৃণ্য বিভক্তকারী আদর্শ যার নাম দ্বিজাতিতত্ত্ব বা টু নেশন থিওরি, যা ’৪৭ সালে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ভারতকে বিভক্ত করেছিল তা ধ্বংস করে দেয়।

যাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখন পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৭ জানুয়ারি, ’৭১ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া যে ভুলের চোরাবালিতে বসে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেকের সংশয় ও আপত্তি সত্ত্বেও প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ কেনো গ্রহণ করলেন, ভোটের ফলাফলই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। এ কথা সত্য, নির্বাচন হয়েছিল অবাধ, নিরপেক্ষ ও ন্যায়সংগত; যার সমালোচনা কেউ করতে পারেনি। আর পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ও তাঁর অঙ্গীকারের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করেছিল। বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁর জনগণের নাড়ি-নক্ষত্র ও অন্তরের খবর। পূর্ব বাংলায় যে তাঁর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি বিচক্ষণ শেখ মুজিব জেনে গেলেও নির্বোধ জেনারেল ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারেননি পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি জেনারেল ও তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতন ঘটে গেছে।

এই নির্বাচন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের মানুষের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমরা ঐক্য দাও, আমি স্বাধীনতা দেব।’ এই নির্বাচনী ফলাফলের মধ্য দিয়ে শুধু ভারতকেই নয়; পশ্চিমকেও তিনি জানিয়ে দিলেন- বাঙালি জনগণ তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং তিনিই তাদের নেতা। স্বায়ত্তশাসন থেকে শোষণমুক্তিতে তাঁর বক্তব্য নিয়ে এসে জানিয়ে দিলেন তিনি যা চাইছেন এখন তা-ই হবে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি তীব্রতার সঙ্গে সংগ্রামের পরবর্তী পর্যায়ে এগিয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এতটাই সুদৃঢ় যে, তিনি গান্ধীজির ’৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলননের মতো কিছু একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ১ মার্চ, ’৭১ ইয়াহিয়া খান যখন ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন তখন হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। এর আগে তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠানে ছয় দফা থেকে একচুল না নড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। সেদিন তাঁকে ঘিরে গোটা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল। ২ থেকে ৬ মার্চ, ’৭১ প্রশাসনিক কর্মকান্ডে জাতীয় হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। এটি একটি গণরাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল; যার পরিপূর্ণ সফলতার জন্য তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। তাঁর নির্দেশ তখন অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর হচ্ছিল। আর পাকিস্তানি জেনারেলদের শাসনের পতন ঘণ্টা বেজেছিল। পাঁচ দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু বন্ধ হয়ে পড়ে। ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের মহাসমাবেশে ৭ কোটি বাঙালিকে তাঁর নির্দেশ জানিয়ে দেন। অসহযোগ কর্মসূচির ডাক দেন এবং তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ ঘটায়। সারা দেশে কালো পতাকা উঠতে থাকে, জয় বাংলা ও শেখ মুজিবের নামে স্লোগানে সেøাগানে এক অকল্পনীয় পরিবেশ তৈরি করল। আর মুজিব ঘোষণা করলেন, বাঙালিদের আর শোষণ-শাসনে দমিয়ে রাখা যাবে না। কারণ তারা মনস্থির করেছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হবে। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান একদিকে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকলেন, অন্যদিকে বেলুচিস্তানের কসাই নামে নিন্দিত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে তিনি পূর্ব বাংলার গভর্নর নিয়োগ করলেন। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু দেখলেন, জাতীয় পরিষদের এই অধিবেশন একটা মুখোশমাত্র। তিনি ইয়াহিয়া খানের আদেশ যেমন অগ্রাহ্য করলেন, তেমনি তাঁর স্বাধীনতার লক্ষ্য স্থির রেখে সব কৌশল গ্রহণ করলেন।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ ইতিহাসের বৃহত্তর জনসমুদ্রে ১৮ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা ও জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। জনগণ সেদিন তাঁকে দেখার এবং তাঁর কথা শোনার জন্য সমবেত হয়েছিল। ততক্ষণে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। গমগমে আবহাওয়ায় তীক্ষè ও আবেগময়, অন্যদিকে চাতুর্যেভরা ভাষণে বঙ্গবন্ধু এটাও বললেন, গণহত্যা বন্ধ করতে হবে, মার্শাল ল তুলে নিতে হবে, জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। বজ্রকণ্ঠ নামে এই ভাষণ স্বাধীনতার ডাক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ায় জেনারেল টিক্কা খান সরাসরি সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। যদিও পরদিন এটি প্রচার করতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এটি রোজ প্রচারিত হয়। ৭ থেকে ২৫ মার্চ, ’৭১ ঝড়ের আগে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। তিনি আলোচনার দরজা যেমন খুলে রাখলেন, তেমনি তাঁর প্রস্তুতিও নিতে থাকলেন। তিনি অনেককে বলছিলেন, যে কোনো সময় তাঁকে আটক করে করাচিতে নিয়ে যাবে, এমনকি ফাঁসিও দিতে পারে। মুক্তির সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। চতুরতার সঙ্গে তিনি যে ফাঁদ পেতেছিলেন, বেকুব ইয়াহিয়া খান সেই ফাঁদে পা দিয়ে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারও গঠন করে। রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর দৃশ্যে বিশ্ব বিস্মিত আর রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্মকর্তারা হয়েছিলেন হতবাক। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি জানতেন, তাঁর এই স্বাধীনতার ঘোষণা সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে নেবে। তিনি বলেছিলেন, জীবিত অবস্থায় ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। দেশদ্রোহের দায়ে তাঁর ফাঁসি হয়ে যাবে। তাই তাঁর আবেদন ছিল, স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ যেন চালিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে গ্রেফতার করে সামরিক বিমানে করে করাচিতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। পরে মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দী হিসেবে সবার থেকে আলাদা রাখা হয়। মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাঁকে ছোট্ট একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়, কোনো পত্রিকা, বই পড়তে দেওয়া হয়নি। ঘরে কোনো টিভি ছিল না। কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারতেন না। তাঁর কক্ষের ছাদ থেকে একটি ফাঁসির দড়ি ঝুলত এবং ঠিক বাইরেই একটি কবর খুঁড়ে রাখত তাঁকে বোঝাতে যে, তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে।

আগামীকাল পড়ুন : লন্ডনে লায়লা হাসানকে কানে কানে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো কীভাবে শেখ মুজিবকে মুক্তির আগাম বার্তা দিয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর