শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত চলছে খুঁড়িয়ে

নেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, পর্যটক হোটেল মোটেলের হিসাব রাখে না বোর্ড

শামীম আহমেদ

অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত চলছে খুঁড়িয়ে

পর্যটনকে বলা হয় ‘অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য’। এখানে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও আয়ের কোনো সীমা নেই।  মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। গত বছর বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৯.৩ শতাংশ ছিল পর্যটন খাতে। পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, তিউনেসিয়ার মতো অনেক দেশ বেকারত্ব দূর ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে সমর্থ হয়েছে। অথচ, বিশ্বের অন্যতম পর্যটনবান্ধব দেশ হয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে তলানিতেই পড়ে আছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭’ অনুযায়ী ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। পর্যটনের বিকাশে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড- বিটিবি প্রতিষ্ঠা করা হলেও ৯ বছরে পর্যটন নিয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয়নি। পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দিবসে র‌্যালি ও সভা-সেমিনারেই সীমাবদ্ধ দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর বিশ্বের মোট জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ আসে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এ খাতের অবদান ছিল ২ হাজার ৯৩৯ বিলিয়ন ডলার যা সমগ্র অর্থনীতির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনে কর্মসংস্থান ছিল ১৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, যা মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৩ ভাগ। গত পাঁচ বছরে প্রতি পাঁচটি নতুন চাকরির একটি সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতে। এ অঞ্চলে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা খরচ করে ৫২৯ বিলিয়ন ডলার যা পুরো রপ্তানি আয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ৮১ ভাগ ভ্রমণ করেন অবসর কাটাতে, বাকিরা ব্যবসায়িক কাজে। বাংলাদেশ সম্পর্কে চলতি বছর সংস্থাটি কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে পর্যটন থেকে, যেখানে বাংলাদেশে এই খাতের অবদান ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল পর্যটন খাতে, যেখানে বাংলাদেশে ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে ২০১৭ সালে বিদেশি পর্যটক থেকে থাইল্যান্ড আয় করে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের আয় ছিল মাত্র দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি পর্যটক থেকে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারের আয়ও ছিল বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যটন বোর্ডে পাঠানো হিসাবে গত বছর বিদেশি পর্যটক থেকে বাংলাদেশের আয় দশমিক ০২ শতাংশের মতো বেড়েছে। এদিকে পর্যটন খাতকে শক্তিশালী করতে তিন বছর আগে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড প্রতিবছর পর্যটক সংখ্যা ১৫ শতাংশ হারে বাড়ানো লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও সংস্থাটির কাছেই নেই বিদেশি পর্যটক আসা-যাওয়ার কোনো পরিসংখ্যান। নেই হোটেল-মোটেলের হিসাব। কত মানুষ পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত তাও জানে না সংস্থাটি। পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে বিদেশি পর্যটকের পরিসংখ্যান নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস তাদের প্রকাশনায় সন্নিবেশ করলেও তা নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পর্যটনে অনেক সেক্টর জড়িত। পর্যটক টানতে পর্যটন স্পট, যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। সহজ করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কাজগুলো ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের নিয়ন্ত্রণে। রাস্তা-ঘাট, হোটেল, যানবাহন- এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের। সুন্দরবনের উন্নয়ন করবে বনবিভাগ। আমাদের তো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের কাজ প্রচারণা। তবে এবার আমরা ২০ বছর মেয়াদি একটা মাস্টারপ্ল্যান করার উদ্যোগ নিয়েছি। এটা করতে মাস তিনেকের মধ্যে প্রতিষ্ঠান বাছাই করে ফেলতে পারব। এই মাস্টারপ্ল্যানটা অনুমোদন করবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন সবাই এটাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। পর্যটনের কোনো তথ্য না থাকা প্রসঙ্গে বলেন, ডাটাবেজ আমাদের নেই। তবে তৈরির চেষ্টা করছি। কত ট্যুরিস্ট আসে-যায় সেই তথ্য থাকে ইমিগ্রেশনে। তাদের সঙ্গে আমরা কথাবার্তা বলছি। চিঠিপত্র লিখছি। তবে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে অগ্রগতি হয়নি। হোটেল- মোটেল, কর্মসংস্থান ইত্যাদির পরিসংখ্যান জোগাড় করে ডাটাবেজ তৈরির মতো জনবল আমাদের নেই। আপাতত কতজন ট্যুরিস্ট আসে এবং থাকে সেই ডাটাবেজ তৈরির চেষ্টা করছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. বদরুজ্জামান ভুঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু পর্যটনের বিকাশ ঘটিয়েই দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির পাশাপাশি অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব। অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকার পরও দক্ষ মানবসম্পদ ও পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশে পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে না। খাতটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় সামনে এগোতে পারছে না। এখনো পর্যটন নিয়ে কোনো মাস্টারপ্ল্যানই হয়নি। পর্যটনের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহ থাকলেও সঠিক লোক সঠিক জায়গায় নেই। পর্যটন বোর্ড, পর্যটন করপোরেশনে যারা কাজ করছেন তাদের এই খাতটি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। পর্যটন নিয়ে যারা পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন তাদের এই খাতে যোগ করতে পারলে ভালো হতো। ঢাবির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগ থেকে ছয়টি ব্যাচ বের হয়েছে, কিন্তু পর্যটন খাতে ক্যারিয়ার প্ল্যান না হওয়ায় তারা এই সেক্টরে ঢুকতে পারছে না। লাখ টাকা বেতন দিয়ে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া থেকে লোক এনে এখানে হোটেল চালানো হচ্ছে। এখানকার ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেলে চিত্র বদলে ফেলতে পারত। সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন না থাকায় সে সুযোগ হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর