রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
সেই শশাঙ্ক ব্যানার্জির এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার-৪

ভুট্টো রোমান্টিকভাবে লায়লাকে বললেন, দিল্লির প্রভুদের জানিয়ে দাও মুজিবকে মুক্তি দিচ্ছি

পীর হাবিবুর রহমান

ভুট্টো রোমান্টিকভাবে লায়লাকে বললেন, দিল্লির প্রভুদের জানিয়ে দাও মুজিবকে মুক্তি দিচ্ছি

শশাঙ্ক শেখ ব্যানার্জি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী একদিকে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জন যেমন দেখতে চেয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিতভাবে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন; সেই জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ সাব’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ সাব ফিরে না এলে স্বাধীন বাংলাদেশ এতিম হবে এবং তার স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবে ইন্দিরা গান্ধীই নয়, ভারতের নীতিনির্ধারক থেকে সামরিক কর্মকর্তারাও মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তার জনগণকে স্বাধীনতার জন্য এতটাই উজ্জীবিত করেছিলেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় আক্রমণ ও গণহত্যা চালালে তারা মুজিবের ডাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা রেখেছিল। ভারতে এক কোটি শরণার্থী যেমন আশ্রয় নিয়েছিল, তেমনি আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম ছাড়াও সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিম বাংলায়। পশ্চিম বাংলার মানুষ তাদের দুহাত ভরে স্বাগত জানিয়েছিল। যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কদের জন্য ছিল উষ্ণ হৃদয়গ্রাহী এক অভিজ্ঞতা। আর তাই সেখানে নির্বাসিত অবস্থাতে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি রেখেই সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে মুজিবনগরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেছিলেন ৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। ১৯ এপ্রিল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ দেয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নেতৃত্বের যেসব শক্তিশালী গুণাবলি ভারতীয় কিংবা বৈশ্বিক নেতার চেয়ে দুটি কারণে সুউচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল তা হলো- ১. তার কৌশলগত দূরদৃষ্টি এবং ২. তার সাহস ও লক্ষ্য স্থিরতা। তিনি প্রতিটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনই করেননি, মুক্তিবাহিনী ও মুজিবনগর সরকারের ওপর সার্বক্ষণিক সহযোগিতামূলক নজর রাখেন। একাত্তর সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তিনি ওয়াশিংটন, প্যারিস, বন ও লন্ডন সফর করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফরে তিনি বিশ্বনেতাদের ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ, শরণার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়া এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জির ভাষায় মনে হচ্ছিল, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, এই গণহত্যা যদি বন্ধ না হয়, শরণার্থীরা যদি বাড়ি ফিরতে না পারে তবে ভারত ও পাকিস্তান ?যুদ্ধ আসন্ন।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তার তীক্ষè বুদ্ধি ও কৌশলগত দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়; তখন ’৬৯ সালেই তিনি বুঝে নেন ভারত ও পাকিস্তানের শত্রুতা কোনো এক চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিশেষজ্ঞ পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করেন যে, কীভাবে নতুন একটি পর্যায়ে এসে ভারত তার পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করবে এবং তিনি তার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে একটি বাহ্যিক অনুসন্ধানী হল তৈরি করবেন যাদের কাজ থাকবে ভারতের প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষত চিরশত্রু পাকিস্তানের ওপর নজর রাখা। আর এভাবেই ’৬৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (RAW)। এর দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই সময়ের গোয়েন্দা গোষ্ঠীর সেরা দুই ব্যক্তির ওপর- রামনাথ কাও এবং শাঙ্কারান নায়ার। তিনি রসিকতা করে বলেন, 'RAW’ শব্দটি শুনতেই রাউলপিন্ডির সংক্ষেপ রূপের মতো লাগতো। যেখানে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অপারেশন হেড কোয়াটার্স ছিল। আবার RAW উল্টো করে পড়লে ওয়ার বা যুদ্ধ মনে হয়। তৈরির পর থেকেই ‘র’ মুক্তির সংগ্রামে সঠিক পথ বাতলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা, গ্রেফতার ও পূর্ববাংলায় ২৫ মার্চ রক্তাক্ত রাতের গণহত্যার পর ইন্দিরা গান্ধী তার যুদ্ধ পরিষদ ও প্রাজ্ঞজনদের এক জায়গাতে জমা করেছিলেন। যারা তীক্ষè কৌশলগত দূরদৃষ্টি ও যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী ছিলেন।

৩ ডিসেম্বর ৭১ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর হামলার ৩ ঘন্টার মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধী অল ইন্ডিয়া রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তানের বিমান হামলা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এর জবাবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তিতে আক্রমণ চালিয়েছে।’ ১৬ ডিসেম্বর ৭১ সালে, ঢাকার সময় বিকাল ৪টায় ও ভারত সময় সাড়ে ৪টায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডিং জেনারেল এ কে নিয়াজি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। সেটি ঘটে ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। যেখানে বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ জনতার জনসমুদ্রে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেদিন আত্মসমর্পণের পর গোটা ঢাকাসহ সারা দেশ বীর জনতার অস্ত্র হাতে জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগানে মুখরিত হয়েছিল।

সেদিন ভর সন্ধ্যায় ইন্দিরা গান্ধী সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকেন এবং নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করেন ‘ঢাকা এখন স্বাধীন দেশের রাজধানী। তাদের বিজয়ের মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণকে অভিবাদন জানাই। যেসব জাতি মানবতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী, এই বিজয়কে তারা স্বাধীনতার জন্য মানুষের অভিযানে একটি ?গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করবে।’ এই বিজয়ের পর ভারত রেখে ডেকে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিল। পৃথিবীর সব দেশে তাদের মিশনে গোপন সার্কুলারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তির জন্য ভারত বা ভারতের জনগণ কারোরই খুব বেশি কৃতিত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ মুক্তির সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষের বহু প্রাণের বিনিময়ে সংগ্রাম ও যুদ্ধের। স্বাধীনতা অর্জন তাদের অর্জন।’ যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতের কাছে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি জনাব এম হোসেনসহ ৯৩ হাজার পাকিস্তানিকে ভারতে নেওয়া হয়। কিন্তু তিনি উচ্চ পদমর্যাদার কারণে যুদ্ধবন্দি হলেও তাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডি পি ধরের বাসায় ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে রাখা হয়েছিল। আর তার স্ত্রী লায়লা হোসেন লন্ডন বেড়াতে গিয়ে কয়েকদিন আগেই আটকা পড়েন। শশাঙ্ক ব্যানার্জি বলেন, ডি পি ধর ছিলেন একজন কাশ্মিরী পন্ডিত। চমৎকার মানুষ। উর্দু ও পারস্যের কবিতার ওপর দখল ছিল। যেহেতু আমি ভারতের হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং উর্দু কবিতা শিখেছিলাম এতে আমাদের উভয়ের দেখা হলেই আমরা উভয়েই উভয়কে উর্দু ও পারস্যের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। ডি পি ধর কূটনৈতিক চ্যানেল এড়িয়ে আমাকে একটি অনুরোধ করেন, লায়লা হোসেনের কাছে তার স্বামীর সিল করা ব্যক্তিগত চিঠি পৌঁছে দিতে। এই চিঠি পেয়ে লায়লা হোসেন নিশ্চিত হন, তার স্বামী সুস্থ, আরামে এবং আনন্দে আছেন। তাদের বার্তা আনা নেওয়া করতে গিয়ে আমিও লায়লা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। সুন্দরী লায়লা আকর্ষণীয় স্মার্ট ও প্রাণবন্ত ছিলেন। আমরা ভারত পাকিস্তান সম্পর্কও বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে সীমাহীন আলোচনা করেছি।

এর মাঝে হঠাৎ খবর এলো নিউইয়র্কের জাতিসংঘ থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো লন্ডন হয়ে পাকিস্তান ফিরছেন। সেখানে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে পাকিস্তানের চিফ মার্সাল ল এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে দায়িত্ব নিবেন। তখন চতুর্দিকে প্রশ্ন ছিল সামরিক আদালতের রায় কার্যকর করে শেখ মুজিবকে কি ফাঁসি দেওয়া হবে? নাকি যাবতজীবন কারাদ-, না মুক্তি? জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর চারপাশে এবং পাকিস্তান আর্মি হেডকোয়ার্টারে অনেক চ্যানেল খোলা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর জন্য। দিল্লি এ বিষয়টিকে গুরুত্বসহ নিল। ইন্দিরা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য অস্থির ছিলেন। নয়াদিল্লিতে ‘র’ এর সেকেন্ড ইন কমান্ড শাঙ্কারাইন নায়ার দারুণ আইডিয়া দিলেন। লায়লা হোসেনকে কেন ভুট্টোর লন্ডন বিরতির সময় কৌশলে মুজিবের মুক্তির বিষয়টি তুলতে বলা হচ্ছে না? নায়ার ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত। লায়লার অতীত ব্যক্তিগত জীবন জানতেন। লায়লা ও ভুট্টো পুরনো বন্ধুই ছিলেন না। তাদের মধ্যে অন্যরকম একটা রোমান্টিক সখ্যতা ছিল। ভুট্টোকে তাই লায়লা আদর করে ‘জুলফি’ বলে ডাকতেন। পাকিস্তানে তারা হাই সোসাইটিতে অবাধ মেলামেশা করতেন। শেষ পর্যন্ত কাজের দায়িত্বটি আমাকে দেওয়া হলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম এই স্পর্শকাতর অপারেশন আমাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। প্রাথমিক চিন্তা ছিল কীভাবে বুঝালে কাজটি হবে? তিনি উত্থাপন করলে ভুট্টো সন্দেহ করবেন না তো?। অপারেশনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের পর সব কিছু প্রস্তুত হলো। লায়লা হোসেন তার ওপর অর্পিত মিশন নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা মতো তিনি তার সঙ্গে গোপনে মাইক্রোফোনসহ রেকর্ডারও রাখলেন। একটি নিখুঁত গোয়েন্দা অপারেশনের রূপ দিলেন তিনি। ব্যানার্জি বলেন, তখন আমার কাছে মনে হলো, পাকিস্তানের সমাজের উচ্চ পর্যায়টি এভাবেই তৈরি। একই সঙ্গে আরও মনে হলো-পাকিস্তান আসলে কি ধরনের রাষ্ট্র! । হিথ্রো বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ‘এলিয়ক এন্ড ব্রাউন স্যুটে’ পৌঁছলেন লায়লা। তিনি ভুট্টোকে তার স্বামীর মুক্তির বিষয়ে ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনা করবেন কিনা জানতে চাইলেন। এমনকি তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে তার স্বামীসহ সব যুদ্ধবন্দিদের বিষয়টি মুক্তির বিষয়ে সহায়ক হতে পারে বলেও মতামত দিলেন। পেশাদারি নির্দেশনা ছাড়াই লায়লার ভাষা এতটাই আসল ছিল যে, শুনতে দারুণ লাগছিল। তার কথা অবশ্যই ভুট্টোর মস্তিষ্কের কোষগুলোকে নাড়া দিয়েছিল। ভুট্টোর উত্তর ছিল তীক্ষè, পরিষ্কার ও ঠাট্টাপূর্ণ।! প্রেমিকার মতোন লায়লাকে লাউঞ্জের এক কোণায় নিয়ে ভুট্টো ফিস ফিস করে বললেন, ‘লায়লা, কেন তুমি তোমার স্বামীকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছো? আমি হোসেনের চেয়ে আরও সুদর্শন পুরুষ তোমার জীবনে দেবো! আচ্ছা, ঠাট্টা ছাড়ো। তোমার পরামর্শের জবাবে বলছি-তুমি তোমার দিল্লির ‘প্রভুদের’ জানাতে পার যে, আমি দায়িত্ব নিয়েই মুজিবকে মুক্ত করে দিব। আশা করি তারপরেই তারা তোমার স্বামীকে মুক্ত করে দিবে। পরে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঠিক করব, এর বদলে কী আমি চাই।’ ব্যানার্জি বরেন, আসলে ভুট্টোও চেয়েছিলেন মুজিবকে মুক্ত করবেন এ খবরটি লিক করে দিতে। শশাঙ্ক ব্যানার্জি বলেন, এটাই স্বাভাবিক যে তার মাথায় ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দি মুক্ত করার বিষয়টি ছিল। আর লায়লা স্বামীর মুক্তির বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। গোটা রেকর্ডিংসহ গোপন যন্ত্র ফিরে এসেই লায়লা আমার হাতে দিলেন। ভুট্টোর বিস্ফোরক উক্তির পর এক্সক্লুসিভ গরম খরবটি সবচেয়ে দ্রুততম কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে দিল্লি পৌঁছে দেওয়া হলো। RAW এর সেকেন্ড ইন কমান্ড শাঙ্কারাইন নায়ার প্রথম খবরটি জানলেন। আর কপি পেলেন আর এন কাউ এবং ডি পি ধর। খবরটি যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাউথ ব্লক অফিসে পৌঁছানো হলো তখন তার প্রতিক্রিয়া ছিল সাবধানী। ‘অপেক্ষা করি, দেখা যাক কি হয়?’ প্রতীক্ষার খেলা শুরু হলো সঙ্গে সঙ্গেই। ভারতের কূটনৈতিক ইতিহাসে এটি সবচেয়ে দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক সময়। হেরল্ড উইলসনের বিখ্যাত উক্তি, ‘রাজনীতিতে একটি সপ্তাহই অনেক বড় সময়।’ দিল্লির উত্তেজনা ভরা আবহাওয়ায় মুজিবের মুক্তির খবর শোনার অপেক্ষা হয়ে উঠেছিল সহ্যের অতীত।

এ পর্যায়ে আমি ব্যানার্জিকে বললাম, আপনারও তো কোড না ছিলো ‘হোসেন’! এটা কী সত্য? আমার ইঙ্গিতে তিনিও হালকা রসিকতার হাসি দিয়ে বললেন, আপনি জানেন কী করে? বললাম, আপনার সম্পর্কে পাঠ করতে গিয়ে। ব্যানার্জি তার মিষ্টি হাসির মাধুর্য্য ছড়িয়ে বললেন, বিচারপতি আর সাঈদ চৌধুরী গণহত্যার আগে এখানে ছিলেন। ঢাকায় গণহত্যা ও মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তি সংগ্রামে এখানেও বিশ্বজনমত গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। গণহত্যার রাতে তার ছাত্রদের নিহত হবার সংবাদ তিনি সইতে পারছিলেন না। তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন আমার সঙ্গে। চমৎকার মানুষ। আমরা ভীষণ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি একদিন বললেন, ফোনে কথা বলার সময় পাশে নানা লোকজন থাকে। একটি কোড নামে ডাকতে চাই। বললাম, আপনার ইচ্ছে। মি: চৌধুরী তখন বললেন, আপনি এখন থেকে ড. হোসেন। আমি আবু সাঈদ চৌধুরীর ‘হোসেন’ ছিলাম, লায়লার হোসেন নয়, বলেই হাসলেন ব্যানার্জি।

আগামীকাল পড়ুন : লন্ডনে মুক্ত শেখ মুজিব ও ১৩ ঘন্টার আকাশভ্রমণে শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে জাতির জনকের যত আলোচনা ও ঘটনা।

সর্বশেষ খবর