রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

জেলা-উপজেলায় পৌঁছায়নি কিট

ঢাকায় আরও নতুন রোগী, বাড়ছে শিশু ও নারী মৃত্যু, উৎকণ্ঠা কাটেনি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

জেলা-উপজেলায় পৌঁছায়নি কিট

রাজধানীর একটি হাসপাতালে গতকাল শিশু ডেঙ্গু রোগী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সারা দেশে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ভাইরাস পৌঁছে গেলেও পৌঁছায়নি রোগ শনাক্তকরণে অপরিহার্য উপাদান কিট। ঢাকার বাইরে অন্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেই কোনো উদ্যোগ। মশক নিধনে তাদের ব্যবহার্য ওষুধ কার্যকর কিনা সে নিয়েও নেই কোনো গবেষণা। তাই বিনা বাধায় জেলা-উপজেলা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬৪৯ জন। এর মধ্যে রাজধানীতেই আক্রান্ত হয়েছেন ৯৬৯ জন। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৮ জন বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রাপ্ত তথ্যে ৬৪ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মাদারীপুরে নাদিরা বেগম (৪০) নামে এক নারী মারা গেছেন। বরগুনায় তাওহীদ নামে দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু জ্বরে। নোয়াখালীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রেলওয়ের কর্মচারী মোশাররফ হোসেন রাজু এবং বেগমগঞ্জের আবদুল মোতালেব নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। 

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়লেও পৌঁছায়নি কিট এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। পটুয়াখালীর নূর ইসলাম এবং হামিদা বেগম তিন দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। শরীরে ব্যথার সঙ্গে ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো দেখা দেওয়ায় পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে গিয়েছিলেন টেস্ট করার জন্য। কিন্তু কিট না থাকায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাই চিকিৎসার জন্য অসুস্থ শরীরে এখন ঢাকায় ছেলের বাসায় আসতে হয়েছে তাদের।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সাইদুজ্জামান বলেন, আমরা ৩০ পিস কিট ক্রয়ের নির্দেশনা পেয়েছি। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় আরও ১৫০ পিস কিটের চাহিদা রয়েছে হাসপাতালে। আমরা সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. শাহ মোজাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ১২০ পিস কিট আজ (গতকাল) হাতে পেয়েছি। এগুলো ৬টি উপজেলায় পাঠানো হয়েছে। এদিকে বরিশালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও সেবার ব্যবস্থা করতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের রোগ পরীক্ষা কিংবা তাদের প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। পৃথক ওয়ার্ড চালুর সরকারি নির্দেশনা থাকলেও তা শুধু প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ। অতিরিক্ত ফি দিয়ে বাইরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষাসহ গ্লুকোজ স্যালাইন এবং অন্যান্য ওষুধও কিনতে হচ্ছে বাইরের ফার্মেসি থেকে।

খুলনায় কিট সংকট চরমে। অবস্থা মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে কিট সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া রোগী বাছাইয়ে দুই স্তরের রোর্ড গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নাটোরে দেখা দিয়েছে কিট সংকট। ঢাকা থেকে আসা রোগীদের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, দেশের অন্যতম বড় পৌরসভা বগুড়ায় বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। মোট ৯১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন সেখানে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কিট মজুদ থাকলেও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষার কিট সংকট রয়েছে। এতে আক্রান্ত হলেও সেবা পাচ্ছে না মানুষ।

শজিমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ জানান, শহর ও গ্রামের মানুষ যে কোনো জ্বর হলেই হাসপাতালে ছুটে আসছেন। এজন্য ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে টেস্ট করায় ভিড় বেশি। বগুড়া জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ জানান, ডেঙ্গু পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক খোঁজ রাখা হচ্ছে। ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত কিট আছে। সরকারি মেডিকেল কলেজ কিট সংকট মোকাবিলার জন্য ঢাকায় চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি ঘটছে জেলা এবং উপজেলাগুলোতে। ঢাকা শহর বাদে ঢাকা বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩২৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৫৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৮৯ জন, খুলনা বিভাগে ৬৬৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৭৭ জন, রংপুর বিভাগে ২৯৯ জন, বরিশাল বিভাগে ৩৮৫ জন, সিলেট বিভাগে ২১০ জন। এ পর্যন্ত প্রায় সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৯০৫ জন আক্রান্ত হলেও ডেঙ্গু নিধনে দেশব্যাপী প্রস্তুতি শূন্যের কোঠায়। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলো নিজেদের পছন্দ মতো মশক নিধন ওষুধ ব্যবহার করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে নেই কোনো গবেষণা। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা যায়, বগুড়া পৌরসভায় ৬ লাখ নাগরিকের মশক নিধন কর্মী রয়েছে মাত্র ৪৫ জন। পৌরসভার প্যানেল চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন শেখ হেলাল জানান, পৌর ওয়ার্ড রয়েছে ২১টি। প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধনে একজন করে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। আর পৌরসভায় রয়েছে ৪ জন। ডেঙ্গুর প্রকোপের কারণে পৌরসভার নিজস্ব তহবিল থেকে আরও ২০ জন অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মশক নিধনে এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের ডেবি সাইপার ১০ ইসি (সাইপার মেথ্রিন) ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অথচ এই ওষুধ কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বলেন, আমাদের সিটি করপোরেশনে নারায়ণগঞ্জের ডক ইয়ার্ড কোম্পানি থেকে ২৫ হাজার লিটার ওষুধ কেনা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের সংগ্রহে আরও ১৬ হাজার লিটার ওষুধ আছে।’ গত ১৫ জুলাই থেকে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। এ কর্মসূচিতে মোট ১৬৩ জন কর্মী আছেন। ফগার মেশিন  আছে ১১০টি এবং স্প্রে মেশিন আছে ৩৫০টি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন এখনো পুরনো ফগার মেশিন ব্যবহার করে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে। নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মশক নিধনের জন্য আছে ৬টি ফগার মেশিন। আর ১২টি ফগার মেশিন থাকলেও সেগুলো সচল নয়। মশক নিধনে ব্যবহার করা হয় এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের ‘ডেবিসাইপার-১০ ইসি’ ওষুধ।

রাসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন জানান, তাদের কাছে এখন মশক নিধনের ওষুধ নেই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যে ওষুধ আমদানি করবে, তারাও সেটি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ঢাকার মেয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ‘ডেবিসাইপার-১০ ইসি’ ওষুধই ব্যবহার করবেন।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ৩৩টি ওয়ার্ডে ফগার মেশিন রয়েছে ১২টি। এর মধ্যে ৪টি নষ্ট। মশক নিধনে আলফা সাইফার মেট্রিন (রেবেন এগ্রো, চায়না-বাংলাদেশ যৌথ কোম্পানি) ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। মশক নিধনে ২২ জন কর্মী কাজ করছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম সুমন বলেন, সিটি করপোরেশনে এসিআই কোম্পানির ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ফ্লোর পাইরিফোস, সাইফার মেট্রিন এবং ল্যামডা সাইহালোথ্রিন মিশিয়ে মশক নিধন কাজ চালানো হয়। এই সিটি করপোরেশনে ৬০টি ফগার মেশিন থাকলেও পরিচালনার জন্য কর্মী রয়েছেন মাত্র ৬ জন। এ ছাড়া ৬০ জন মশক নিধন কর্মী এবং ১০ জন সুপারভাইজার রয়েছেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম বড়ুয়া বলেন, মশক নিধনে কোরিয়ান কোম্পানির ‘অ্যাডাল্টিসাইট’ এবং পদ্মা অয়েলের ‘রিফ কট’ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে ১০০ জন মশক নিধন কর্মী দিয়ে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিদর্শক মদন চন্দ্র দাস বলেন, এসিআই কোম্পানির ‘লিকুইড ইনসেক্টিসাইড’ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই সিটি করপোরেশনে ১২ জন মশক নিধন কর্মী কাজ করেন এবং ফগার মেশিন রয়েছে ১২টি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মশক নিধনে সিটি করপোরেশন এসিআই কোম্পানির ‘২.৫ এলবি’ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। মশক নিধনে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ফগার মেশিন রয়েছে ৮টি এবং মশক নিধন কর্মী রয়েছেন ২০ জন।

সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা ও এডিস মশার লার্ভার সন্ধান পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিনে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অ্যান্টোমোলজি টেকনিশিয়ানরা বেশ কয়েকটি সরকারি ভবনে এডিস মশা ও লার্ভার সন্ধান পেয়েছে। এ নিয়ে পৌরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পৌর কর্তৃপক্ষ ও সিভিল সার্জন অফিস বলছে, মশক নিধনে ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে। শুধু পৌরসভায় মশক নিধন ওষুধ স্প্রে করা হলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো প্রকার স্প্রে করা হচ্ছে না। তিন দিন আগে কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল গ্রামের এক যুবক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এ নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। সিভিল সার্জন ডা. জাহিদুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গু যাতে না ছড়ায় সে জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পৌর মেয়র সৈয়দ আবদুর রউফ মুক্তা জানান, মশা ও লার্ভা নিধনে দুটি ফগার মেশিন ও ৬টি স্প্রে মেশিন দিয়ে পৌরসভার বিভিন্ন অলিগলিতে ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর