জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত খুনিচক্রের সহযোগীরা এখনো দেশে-বিদেশে সক্রিয়। ইতিহাসের জঘন্য, বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ডে জড়িত ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্রকে বিদেশে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছিল জিয়ার শাসনামলে। দেশে ফিরে আসে তারা এরশাদ আমলে। এ সময় তারা ফ্রিডম পার্টি নামে একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলে। দেশের যত অস্ত্রবাজকে এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। ফ্রিডম পার্টির ছাত্র-যুব সংগঠনের পাশাপাশি মুখপত্রও ছিল। নাম ‘দৈনিক মিল্লাত’। ধানমন্ডি ও মতিঝিলে তাদের অফিস ছিল। এ ছাড়া সারা দেশে দলটি অফিস খুলে অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের সংগঠিত করে। সেই সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ফ্রিডম পার্টির নামে সভা-সমাবেশ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সূত্রমতে, ফ্রিডম পার্টি নামক সংগঠন ১৯৮৬, ’৮৮, ’৯১ ও ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও অংশ নেয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের দীর্ঘ অনুসন্ধানে ফ্রিডম পার্টির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের তালিকা, তাদের সন্তানদের কার্যক্রম, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হামলা ও তাদের হাতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের খুন ইত্যাদি যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ক্রমান্বয়ে তুলে ধরা হবে পাঠকদের সামনে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুনিদের সন্ত্রাসী দোসরদের অনেকে এখনো বহাল তবিয়তে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, আবার কেউ কেউ সরকারি দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।
জানা গেছে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকারী ১২ খুনির মধ্যে ছয়জন এখনো পলাতক। এর মধ্যে কানাডায় আশ্রয় নিয়েছেন নূর চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এম রাশেদ চৌধুরী। অন্য চারজনের সঠিক অবস্থান কোথায় তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি সরকার। তবে কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম ইউরোপে সেনজেনভুক্ত দেশে অবস্থান করছেন- এটা অনেকটাই নিশ্চিত বাংলাদেশ পুলিশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাদের হাতে সপরিবারে হত্যার শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে ২০১০ সালে পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। পলাতক সাতজনের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান এবং বাকি ছয়জন পলাতক। এরাই পরে বাংলাদেশে গড়ে তোলেন সশস্ত্র দল।সূত্র জানায়, ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট শেরাটন হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে ফারুক রহমানকে চেয়ারম্যান করে ফ্রিডম পার্টির আত্মপ্রকাশের কথা ঘোষণা করা হয়। পার্টির কো-চেয়ারম্যান কর্নেল রশীদ। ভাইস চেয়ারম্যান হন বজলুল হুদা। পার্টি গঠনের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সশস্ত্র অপারেশনে যায় তারা। জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে ফারুক-রশীদের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টির খোলা জিপ থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে নিহত হয় এক কিশোর। চলতে থাকে তাদের ধারাবাহিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। আওয়ামী লীগের ওপর একের পর এক হামলা চালায় তারা। ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহে বজলুল হুদার ক্যাডারের গুলিতে প্রাণ হারান এক ব্যবসায়ী। ’৮৯ সালের ১০ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ হাসিনার ওপর বোমা ও গুলিবর্ষণ করে অস্ত্রধারীরা। বোমা ও গুলিবর্ষণ করেই তারা ফ্রিডম পার্টি জিন্দাবাদ, ফারুক-রশীদ জিন্দাবাদ স্লোগান দেয়।
সূত্রমতে, অস্ত্র আর টাকার লোভ দেখিয়ে ছাত্র ও যুবসমাজকে ফ্রিডম পাটিতে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করা হতো। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র, অর্থ ও ক্ষমতার লোভে পড়ে দলে দলে যোগদান করতে থাকে একশ্রেণির তরুণ। এদের অনেককেই আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লিবিয়ায়। এই যুবকদের তারা বলেছিল, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়া হবে। কয়েক শ যুবককে বিশেষ করে দেশের তালিকাভুক্ত অপরাধী ও সর্বহারাদের বেছে বেছে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। তিন থেকে নয় মাস পর্যন্ত তাদের সেখানে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেশে ফিরিয়ে এনে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় রাজনীতির মাঠে। এদের হাতে তখন চকচকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র শোভা পেতে থাকে। খোলা জিপে করে অস্ত্র উঁচিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। মূলত বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপকতা পায় লিবিয়া ফেরত ওই যুবকদের মাধ্যমেই। এ অস্ত্রবাজরাই পরে বিভিন্ন স্থানে উন্মত্ত হামলা চালায় যার অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা।
১৯৮৬ সালে কর্নেল ফারুক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। পরের বছরই ফারুক-রশীদ ফ্রিডম পার্টি নামে সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দলটি গঠন করেন। ’৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুড়াল মার্কায় মেহেরপুর থেকে বজলুল হুদা নির্বাচিত হন। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে কর্নেল রশীদ কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত হলে তাকে তথাকথিত বিরোধী দলের নেতা বানানো হয়। সর্বশেষ নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় ফ্রিডম পার্টি। তবে ফ্রিডম পার্টির স্থায়ী গঠনতন্ত্র জমা হয়নি, তাই ২০০৯ সালে দলটির নিবন্ধন বাতিল করে ইসি।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এনসিবি) মহিউল আলম বলেন, ‘আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ব্যাপারে ১৯৪ দেশের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছি। তবে চীন, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, ইউকে, লিবিয়া, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো আমাদের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। সর্বশেষ রিসালদার আবদুল মাজেদের অবস্থানের বিষয়টি আমরা জানতে চেয়েছিলাম ভারত ও পাকিস্তানের কাছে। দু-তিন দিন আগে ভারত উত্তর দিলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোনো কিছুই জানানো হয়নি।’ বাকিদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শরিফুল হক ডালিম ও খন্দকার রশীদ ফ্রান্স, ইতালি, লিবিয়া, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে আমরা একাধিক সূত্রে জানতে পেরেছি। তবে কোনো দেশই আমাদের তা আনুষ্ঠনিকভাবে জানায়নি।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী, মাহবুব মমতাজী, রাশেদ হোসাইন, শরিফুল ইসলাম সীমান্ত ও নাসিমুল হুদা।