শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন কাশ্মীর নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা মোদির

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

এখনো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন কাশ্মীর নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা মোদির

জাতির উদ্দেশে ভাষণে নরেন্দ্র মোদি

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলকে কেন্দ্র করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা কাশ্মীর এখনো সেই অবস্থাতেই আছে। এ কারণে কাশ্মীরের প্রকৃত অবস্থা জানা যাচ্ছে না কিছুতেই। বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও আসলে কাশ্মীরের মানুষ কেমন আছে সে খবর পাচ্ছে না তাদের স্বজনরাও। গত রবিবার থেকেই উপত্যকাটিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জারি করা হয়েছে কারফিউ। তবে এরই মধ্যে জম্মু কাশ্মীর গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। রাজধানী শ্রীনগরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অজিত দোভালের সঙ্গে সাধারণ কাশ্মীরিদের সাবলীলভাবে খাবার গ্রহণের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এদিকে, কাশ্মীর ইস্যুকে ভারতের পক্ষ থেকে পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলা হয়েছে। তবে এ ইস্যুতে প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উত্তেজনা উদ্বিগ্ন করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে। কাশ্মীর ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন পক্ষ। অবশ্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনমন করা পাকিস্তানকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে ভারত। সেই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আশা প্রকাশ করেছেন, অন্ধকার কাটিয়ে কাশ্মীরবাসী শিগগিরই এক নতুন সূর্যোদয় দেখতে যাচ্ছে। গত রাতে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে কাশ্মীর  উপত্যকা ও সেখানকার অধিবাসীদের উন্নয়নে নানান পরিকল্পনার কথা জানান। মোদি বলেন, অনেক চিন্তাভাবনা করেই জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনে আনা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর ওই এলাকায় বিক্ষোভ ঠেকাতে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযানে কর্তৃপক্ষ অন্তত ৩০০ রাজনীতিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে আটক করেছে। পুলিশের কর্মকর্তা, বিভিন্ন দলের নেতা ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে রয়টার্সের খবরে বলা হয়, শ্রীনগরের বিভিন্ন সড়কে আধাসামরিক পুলিশের হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েন আছে। স্কুলসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকার সড়কে আছে ব্যারিকেড। এর মধ্যেও বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবাদ বিক্ষোভের খবর মিলছে বলে জানিয়েছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তারা। কর্মকর্তাদের একজন বলেছেন, শ্রীনগরের অন্তত ৩০টি স্থানে সৈন্যদের ওপর পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের প্রতিক্রিয়ায় আহত অন্তত ১৩ জনকে শহরটির প্রধান সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় শ্রীনগরের পুরনো শহরে কয়েক মিটার পরপর দূরত্বে রায়ট গিয়ার নিয়ে পুলিশ সদস্যদের প্রস্তুত থাকতে দেখা গেছে; কয়েকশ মিটার পরপর ছিল কাঁটাতারের চেকপয়েন্ট। দীর্ঘদিন ধরে শ্রীনগরে বিক্ষোভের প্রধান কেন্দ্রস্থল জামে মসজিদের কাছে অন্তত তিনটি স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন উল্টর-পশ্চিম শ্রীনগরের বেমিনা এলাকাতেও পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, মানুষের মধ্যে ভয়াবহ ক্ষোভ বিরাজ করছে। কাশ্মীরিরা আশঙ্কা করছেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিশেষ সুবিধাদি বাতিলের মাধ্যমে ভারতের অন্য অঞ্চলের লোক ঢুকিয়ে কাশ্মীরের জনমিতি বদলানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ কারণেই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে প্রচার চালানো ৩০০ রাজনীতিককে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। আরেক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বাইরে থেকে খবর সংগ্রহ করতে কাশ্মীরে যেসব সাংবাদিক গেছেন, তাদের প্রায় কেউই সর্বশেষ খবরাখবর জানাতে পারছেন না। বন্ধ মোবাইল আর ল্যান্ডলাইন ফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা, এমনকি কেবল টিভিও বন্ধ। বিবিসির সংবাদদাতা জুবেইর আহমেদ বেশ কয়েক দিন চেষ্টার পরে কোনোক্রমে সেখানকার পরিস্থিতি আর মানুষের কথা রেকর্ড করে দিল্লিতে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজধানী শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি মাইকে বলতে বলতে যাচ্ছে যে- কারফিউ জারি রয়েছে, কেউ যেন বাড়ির বাইরে না বের হন। রাস্তাঘাট সুনসান কদিন ধরেই। প্রতিটি রাস্তায়, গলির মুখে নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারা। কোথাও মানুষজন প্রায় চোখেই পড়ছে না। যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি, তারা সবাই সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তারা বলছেন, বেশির ভাগ নেতাই আটক হয়েছেন, তারা ছাড়া পাওয়ার পরে যেভাবে নির্দেশ দেবেন, সেভাবে প্রতিবাদে রাস্তায় নামবেন মানুষ। তবে জম্মু আর লাদাখ অঞ্চল থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানকার বহু মানুষ সরকারের এ সিদ্ধান্তের পরে বিজয়োল্লাস করেছেন। ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে আনন্দোৎসব, মিষ্টি বিলি ও নাচ এসব হচ্ছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের পদক্ষেপে প্রতিবেশী পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তারা এরই মধ্যে ইসলামাবাদের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার ও নয়াদিল্লির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে অনিচ্ছুক ভারত তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেইনি। বরং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনমন ও দ্বিপক্ষীয় সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের ব্যাপারে পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে ভারত। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, কূটনৈতিক যোগাযোগের স্বাভাবিক চ্যানেল বজায় রাখার স্বার্থে পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। ভারতের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারে বিশ্বের কাছে একটি ভীতিকর চিত্র তুলে ধরতেই পাকিস্তান ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার জানিয়েছে, কাশ্মীরের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। ইসলামিক দেশগুলোর জোট ওআইসিও ভারতের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে দেওয়া বিশেষ সুবিধা বাতিলের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে অবগত করা হয়েছে বলে নয়াদিল্লি দাবি করলেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, তাদের এ সম্বন্ধে জানানো হয়নি। লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে চীনও। বেইজিং দীর্ঘদিন ধরেই ভারতশাসিত কাশ্মীরের লাদাখ অংশের মালিকানা দাবি করে আসছে। চীন তাদের বিবৃতিতে পাক-ভারত বিবাদে পক্ষ না নেওয়ার কথা জানালেও ‘চীনের স্বার্থে ঘা লাগলে তা সহ্য করা হবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। গত মঙ্গলবার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে ভারতের সরকার। ওই দিন ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫(এ) অনুচ্ছেদ বাতিল করে লোকসভায় বিল পাস করে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে, কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান থাকবে। এ ছাড়া সামরিক, যোগাযোগ এবং পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজ্য সরকারের অনুমোদন লাগবে। অনুচ্ছেদগুলো বাতিলের ফলে কাশ্মীরের জনগণ তাদের রক্ষাকবচ হারিয়ে ফেলে।

সর্বশেষ খবর