শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঈদের আগে কাশ্মীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ

ইন্টারনেট ও টেলিফোন চালু, হস্তক্ষেপ না করার ঘোষণা জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পরিস্থিতি। সাত দিন পর সেখানে গতকাল ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ চালু হয়েছে। জুমার নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে জনসাধারণের চলাচল উন্মুক্ত করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে আগের মতোই বাড়তি সেনা সদস্য মোতায়েন রয়েছে এ উপত্যকায়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো গতকাল এসব তথ্য জানিয়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে প্রতিবেশী পাকিস্তানের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে জাতিসংঘ। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় শাসন জারি অভ্যরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। নয়াদিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন সরকারের কাশ্মীরবিষয়ক কার্যকলাপের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখছেন। তাদের মতে, জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠনে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ‘নতুন কোনো ব্যাপার নয়’। এটা চলমান একটি প্রক্রিয়ারই অংশ।

কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, আগামী সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকার কাশ্মীর রাজ্যপালকে নিরাপত্তা প্রতিবেদন দিতে বলে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গতকাল ইন্টারনেট ও ফোন সংযোগ চালু করা হয়। ফলে কাশ্মীরের জনজীবনে ওঠা নাভিশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে ঈদের আগে কোনোরকম অশান্তির উসকানি এড়াতে এখনই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বা ওমর আবদুল্লাহকে গৃহবন্দী রাখার সিদ্ধান্তেই অনড় দিল্লি সরকার। এ কারণে তারা এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের বিলোপকে কেন্দ্র করে উপত্যকায় কোনোরকম অস্থিতিশীলতা চায় না মোদি সরকার। আবার কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ধর্মীয় ভাবাবেগ যাতে কোনোভাবে ক্ষুণœ না হয়, সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার নিজের বক্তৃতায় কাশ্মীরের মানুষের দুরবস্থার কথা স্বীকার করে নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই সঙ্গে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কাছে আবেদন রাখেন, যদি বিচ্ছিন্নতাবাদ আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরবাসী নিজেরাই রুখে দাঁড়ায়, তাহলে ভূস্বর্গের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর পাকিস্তান জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপের মাধ্যমে ভারত জাতিসংঘের গৃহীত প্রস্তাব লঙ্ঘন করেছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি চিঠি লেখেন মহাসচিব গুতেরেসকে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট জোয়ানা রোনেকার সঙ্গে বৈঠকও করেন এ বিষয়ে। ওইদিন তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লেখা চিঠি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির হাতে তুলে দেন বলে টুইটে জানিয়েছেন মালিহা নিজে।

‘পথ অবাধ হয়েছে’ : ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাশ্মীরের সুশাসন এবং সামাজিক-আর্থিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উন্নত হওয়ার পথ অবাধ হয়েছে। তারা বলেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০ সংবিধানভুক্ত হয়েছিল ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা’ হিসেবে। অস্থায়ী ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার লক্ষ্যেই সরকার সংসদের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে।

‘রাষ্ট্রপতি যে আদেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের শাসনমর্যাদার রীতি স্থির করলেন তা খুবই যৌক্তিক’ বলছেন দিল্লির বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর ভারতে যোগ দেয় জম্মু ও কাশ্মীর। সংবিধান বলবৎ হয় ১৯৫০ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত রাজ্যটির আইন ও রীতিনীতি নির্দিষ্টকরণের জন্য রাষ্ট্রপতির ৫৪টি আদেশ জারি হয়েছে। এসব আদেশের উদ্দেশ্য হলো কাশ্মীরের শাসনব্যবস্থাকে দেশের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সুবিন্যস্তকরণ।

সংবাদপত্রের বিভিন্ন নিবন্ধে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৪-১৯ সালে কাশ্মীরকে ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি রুপি দিয়েছে। দুর্নীতি আর অনিয়মের ফলে এসব বরাদ্দ কাক্সিক্ষত মাত্রার অবকাঠামোগত উন্নয়নে লাগেনি। কেন্দ্র ওই রাজ্যকে যত অনুদান দিয়েছে তার মাত্র ১৭ শতাংশের সুফল ১ শতাংশ লোকের কাছে পৌঁছেছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুযোগে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে তৈরি হয়েছে বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ। অথচ রাজ্যটির সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্নতার বিরোধী।

‘হোয়াইট হাউসের ঘোষণা’ : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস বলেছে, দ্বিপক্ষীয় ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে না। গতকাল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখপাত্র মর্গান অর্টাগাস ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, আমেরিকার ঘোষিত কূটনৈতিক নীতি অনুযায়ী, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা। সেখানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ করার পক্ষপাতী নয় হোয়াইট হাউস। ৩৭০ ধারা বিলোপের পরও এই নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দুই দেশকেই শান্ত ও ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে। ‘আমরা শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। কাশ্মীর এবং অন্যান্য ইস্যুতে আমরা সব সময়ই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে সমর্থন করি।’

জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ঘোষণার পর গতকাল নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে সংবাদ সম্মেলন করেন ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রবিশ কুমার। মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান বাস্তবতা মেনে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। বাস্তবতা মেনে অন্য দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা উচিত পাকিস্তানের।

এর আগে, জম্মু-কাশ্মীর সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদে কর্মরত ভারতের হাইকমিশনারকে বহিষ্কার করে পাকিস্তান। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনমনের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সেদিনই দুই দেশের মধ্যে চলাচল করা ট্রেন ‘সমঝোতা এক্সপ্রেস’ বন্ধ করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের এমন কঠোর পদক্ষেপ সত্ত্বেও ভারতের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে না যাওয়ার নীতি গ্রহণ করে ভারত। তখন নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বানও জানানো হয়।

সর্বশেষ খবর