শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অস্ত্রের রাজনীতি

জেলা-উপজেলায় ফ্রীডম পার্টির অফিস, অস্ত্রভান্ডার, ছাত্র কমান্ড যুব কমান্ড মহড়া দিত হুড খোলা জিপে চড়ে, লিবিয়াতে হতো ট্রেনিং

বিশেষ প্রতিবেদন

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে সশস্ত্র রাজনীতি শুরু করে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের খুনিদের দল। পাঁচ সদস্যের একটি শক্তিশালী নির্বাহী কমিটি তৈরি করে গঠন করা হয় ‘ফ্রীডম পার্টি’। একে একে প্রতিটি জেলা ও শহরে ফ্রীডম পার্টির অফিস খোলা হয়। আর এ অফিসগুলোই পরিণত হয়েছিল অস্ত্রের ভান্ডারে। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও নির্বাহী কমিটি নিয়ন্ত্রণ করত সারা দেশের ফ্রীডম পার্টির কমিটিগুলো। দল গঠনের পরই ফ্রীডম পার্টির যুব ও ছাত্র কমান্ড রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয় হুডখোলা জিপে চড়ে মহড়া দিতে শুরু করে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই থাকত চকচকে সব আগ্নেয়াস্ত্র। আর এ সবকিছু হতো আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সামনেই। রাজধানীর ফকিরাপুলে অবস্থিত লিবিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৪/এ সড়কের ৩৪ নম্বর বাসায় ছিল তাদের দুটি অফিস। সেখানেই তারা তাদের পরিকল্পনা তৈরি করত।

তথ্যাভিজ্ঞরা জানান, স্বাধীন বাংলাদেশে একটি প্রজন্মের হাতে ফ্রীডম পার্টি তুলে দিয়েছিল অত্যাধুনিক অথচ অবৈধ সব আগ্নেয়াস্ত্র। আর ওইসব আগ্নেয়াস্ত্রের একটি বড় অংশ এখনো ব্যবহার হচ্ছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে পেশাদার খুনিরা। সূত্র জানান, ফ্রীডম পার্টির নেতারা রাজধানী থেকে দুর্ধর্ষ সব অপরাধীকে দলে ভেড়ান। যাদের পেশা ছিল ভাড়ায় খুনখারাবি করা তাদেরই ফ্রীডম পার্টিতে ঢোকানো হয়। এ ক্ষেত্রে রাজধানীর শাহজাহানপুর, কমলাপুর, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার ও তেজগাঁও এলাকায় টার্গেট করে তারা সন্ত্রাসীদের ফ্রীডম পার্টিভুক্ত করে।

ফ্রীডম পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে সশস্ত্র ট্রেনিং নিতে লিবিয়া গিয়েছিলেন, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তারা জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশীদ লিবিয়ায় থাকা অবস্থায় ফ্রীডম পার্টির কর্মীদের লিবিয়া সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। লিবিয়ায় কয়েক শ যুবককে তিন থেকে ছয়, এমনকি নয় মাস পর্যন্ত সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। লিবিয়ায় আধুনিক অস্ত্রে প্রশিক্ষিত ক্যাডাররাই ছিল ফ্রীডম পার্টির প্রধান ভিত্তি। তাদের যেসব আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, দেশে ফিরে আসার পর তাদের হাতে সে ধরনের অস্ত্রই তুলে দেওয়া হতো।

যেভাবে ফ্রীডম পার্টি : বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৮ সালে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করে খুনিরা। এ লক্ষ্যে ১৯৭৮ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত আবুধাবিতে তৎকালীন ফার্স্ট সেক্রেটারি কর্নেল শাহরিয়ার রশীদের বাসায় নিয়মিতভাবে বসতেন মেজর বজলুল হুদা, মেজর নূর, কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর পাশা। প্রথমে তারা গড়ে তোলেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলÑপ্রগদ। কিন্তু বেশিদিন না যেতেই ভাঙনের সুর শুরু হয়।

কর্নেল রশীদ ১৯৮৬ সালের ৩ ডিসেম্বর দেশে ফেরার পরই তার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি-প্রগশ নামে একটি দলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি প্রগশে যোগ না দিয়ে ’৮৭ সালের ৩ আগস্ট বেলা ১১টায় হোটেল শেরাটনের বলরুমে এক সংবাদ সম্মেলন করে ফ্রীডম পার্টির ঘোষণা দেন। এর আগে তৎকালীন লিবিয়ান রাষ্ট্রদূত এবং লিবিয়ান সংবাদ সংস্থা ‘জানা’র প্রতিনিধি চৌধুরী ফারুকের সঙ্গে পরামর্শ করেন কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ।

পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ছিল দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ও নির্বাহী কমিটি। সদস্য ছিলেন মাত্র পাঁচজন। এর মধ্যে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, কো-চেয়ারম্যান কর্নেল খন্দকার রশীদ, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর বজলুল হুদা ও চৌধুরী মো. ফারুক অন্যতম।

ফ্রীডম পার্টির উপদেষ্টা পরিষদও ছিল। কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। উপদেষ্টা পরিষদ ও উপদেষ্টা কমিটি। উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল রশীদ। সূত্র জানান, কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কমিটির কো-চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) আবদুর রশীদ, আঞ্চলিক কো-অর্ডিনেটর ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপিকা আজরা আলী অ্যাডভোকেট। উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মিয়া আবদুর রশিদ, অ্যাডভোকেট আবদুল আহাদ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় অঞ্চলের স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন এ বাবুল রিবেরো। ঢাকা জেলা স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ফারুক রেজা, ৪ নম্বর অঞ্চলে স্টাফ কো-অর্ডিনেটর রফিকুল ইসলাম, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের রিজিওনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর লিয়াকত আলী অ্যাডভোকেট। দক্ষিণাঞ্চলের রিজিওনাল উপদেষ্টা আনোয়ারুল হুদা। উত্তরবঙ্গ জোন-২ রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর আতিকুর রহমান। রংপুর-দিনাজপুর জোন-১ স্টাফ কো-অর্ডিনেটর মো. এ লতিফ চৌধুরী।

মহিলা সেল : কো-অর্ডিনেটর তাসমিয়া রহমান। নগর উপদেষ্টা সেলিনা বেগম।

ঢাকা মহানগরী কমিটি : সিটি কো-অর্ডিনেটর খন্দকার কাজল, ইকবাল আহমদ, হুমায়ন কবির। তেজগাঁও থানা কো-অর্ডিনেটর মোস্তাক আহম্মদ (কালু)। এ ছাড়া তেজগাঁওয়ের আবুল কালাম, আজিজুল হক বান্না, আলাউদ্দিন, রহিম, মকবুল, ভুলু, কাদের, মামুন, খালেক, সেলিম, আলী হোসেন, লাল মহাজন, বাশার।

মতিঝিল থানার কো-অর্ডিনেটর হাদী নেওয়াজ খান বাহার, সবুজবাগ থানা কো-অর্ডিনেটর ভূঞা বাবুল। এ ছাড়া এ এলাকায় ছিলেন হুমায়ুন কবির, বাদল, সুভাষ, শরীফ, ইকবাল, কচি সোহরাব, মইনুল, ছোট কাজল ও বাবু। ডেমরা থানা কো-অর্ডিনেটর ইকবাল আহমদ, সূত্রাপুর থানা কো-অর্ডিনেটর মঞ্জুরুল হক কচি, মোহাম্মদপুর থানা কো-অর্ডিনেটর আমানুল্লাহ আমান, হুমায়ুন কবির সোহরাব, হালিম, টিটু, বাবু, সেলিম, ছোট বাবুল, জর্জ, মামুন, সালাউদ্দিন।

জেলা কমিটি : নারায়ণগঞ্জের কো-অর্ডিনেটর কামাল আহমেদ, জামালপুর জেলায় আবুল হাশেম, শরীফ হোসেন, শহর কমিটিতে ছিলেন রেজা খন্দকার, বাবুল আহমেদ। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, তাজুল ইসলাম, ফরিদ হোসেন, টিপু, রূপু, টিটু ও মিন্টু। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা কো-অর্ডিনেটর এ কে এম রেজা উল করীম। মেহেরপুর জেলার স্টাফ কো-অর্ডিনেটর মো. নুরুন্নবী বাবু। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর জেলার জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর রফিকুল ইসলাম, যশোর-নড়াইল জেলা জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর গোলাম সারওয়ার, খুলনা-সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জ জেলার জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর বেগ মোহাম্মদ তানভীরুল আজম, বাগেরহাট-পিরোজপুর জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর শেখ আবদুল মান্নান, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর খন্দকার আবদুল মান্নান।

পটুয়াখালীর উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল, পটুয়াখালী শহর কো-অর্ডিনেটর খন্দকার আওলাদ হোসেন, স্টাফ কো-অর্ডিনেটর হায়দার পারভেজ, বরগুনার কো-অর্ডিনেটর আজিজ বিএসসি, স্টাফ কো-অর্ডিনেটর কামাল হোসেন জালাল।

শেরপুরের লালবাগ থানা এলাকায় যারা ফ্রীডম পার্টিতে অ্যাকটিভ ছিলেন তারা হলেন হুমায়ুন কবির, গিয়াস উদ্দিন বাবলু, মো. মোস্তফা, মো. ফারুক, মো. আলাউদ্দিন, মোবারক উল্ল্যা আকবর, মো. আয়ুব হোসেন মুসা, মো. শফি, মো. রাজু, বাদল ও মালেক। যশোর-নড়াইলের জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন এ কে এম জি ছরোয়ার, রিজিওনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন অ্যাডভোকেট লিয়াকত হোসেন। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন ফজলুর রহমান। পাঁচবিবি উপজেলার কো-অর্ডিনেটর এম এ হামিদুর রহমান, ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর কামরুল হানিফ এবং ফারুকুজ্জামান চৌধুরীকে স্টাফ কো-অর্ডিনেটর করে ওই এলাকায় ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। শেরপুর সদর উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ, ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ সালামত উল্লাহ খান ও ডা. আবদুল মান্নান। সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ জুবাইদুল ইসলাম, ফজলুল হক চান ও আওরঙ্গজীব। নালিতাবাড়ী উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন খোরশেদ আলম। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম, জেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সিদ্দিক মিয়া, জেলা ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর ছিলেন নূরুল আলম মাখন, ফারুক রহমান ও মাসুদ সিদ্দিক। মাগুরা-ঝিনাইদহের জোনাল স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন আনোয়ারুল করিম রুন্টু, মনিরামপুরের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন ইমান আলী, কালিয়ার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সুলাইমান, যশোরের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন ইসলাম পালোয়ান। অন্যান্য নেতার মধ্যে ছিলেন জাহাঙ্গীর ও আসাদ। গাইবান্ধার ফুলবাড়ী উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মো. সফিউদ্দৌলা, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন আবদুস সাত্তার, সাঘাটা উপজেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মকবুল হোসেন, পলাশবাড়ী উপজেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সৈকত আজগর। জেলা নেতৃবৃন্দ ছিলেন কামরুল হাসান, সামছুল আলম মন্টু, শাহ মোকলেছুর রহমান। চট্টগ্রামের স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন নিজামুল আমিন। মেহেরপুরের উপদেষ্টা ছিলেন আকবর আলী, উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্য ছিলেন নূরুল ইসলাম, মো. আরিফুল ইসলাম, মো. আ. আউয়াল, মো. আ. বাকি, মো. রবিউল হক, মো. সোলায়মান আলী, মো. আ. কাদের, মো. ওসমান আলী, মো. আ. গনি বিশ্বাস, মো. নূরুল হুদা, মো. আতাহার আলী, মো. লুৎফর রহমান, মো. আশরাফুল ইসলাম। গাংনী উপজেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন মুজিবর রহমান, বিকল্প কো-অর্ডিনেটর ছিলেন আরিফুল ইসলাম, স্টাফ কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সাবদাল হোসেন। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মো. আ. রউফ, মো. আজিজুল হক, আ. মতিন, মো. রাহাতুল্লা, সামছুজ্জোহা, আ. বারী, আ. আউয়াল ও মতিয়ার রহমান। সিলেট জেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন ফয়জুল আলম বাবুল ও মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। হবিগঞ্জ জেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন সামছুল হুদা ও গোলাম তৌহিদ বুলবুল। জামালপুর জেলা কো-অর্ডিনেটর ছিলেন হারুন উর রশীদ, স্টাফ কো-অর্ডিনেটর মো. হাশিম উদ্দিন, ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর শরীফ হোসেন, শহর কো-অর্ডিনেটর মো. রেজা খন্দকার, শহর স্টাফ কো-অর্ডিনেটর আ. মতিন। উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আক্তারুজ্জামান।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন যারা : মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, গোলাম রাব্বানী ও মাহবুব মমতাজী।)

সর্বশেষ খবর