শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

চামড়া নষ্টের দায় নিচ্ছে না কেউ

সব পক্ষকে তলব মন্ত্রীর

মানিক মুনতাসির

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় প্রায় ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে, যা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে কিংবা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের এই সম্পদ নষ্টের দায় নিচ্ছে না কেউ। চামড়া আড়তদার সমিতি, ট্যানারি মালিক সমিতি, মৌসুমি ব্যবসায়ী- কোনো পক্ষই এর দায় নিচ্ছে না। এমনকি কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে আড়তদার, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সমঝোতা হয়নি এখনো। এই সংকট সমাধানে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে জরুরি তলব করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রবিবার ১৮ আগস্ট সচিবালয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের ডাকা হয়েছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্য কারা? সরাসরি তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে। অবশ্য এর আগে ১৭ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রীর দেশের বাইরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি না থাকলে বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মফিজুল ইসলাম। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চামড়া নষ্টের দায় সবাইকে নিতে হবে। এমনকি যারা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন বা পানিতে ফেলে দিয়েছেন, তারাও এর দায় এড়াতে পারেন না। মাদ্রাসার লোকেরা চাইলে তো লবণ মাখিয়ে চামড়াগুলো কয়েক দিন রাখতে পারতেন। পরে সরকার বিষয়টি সমাধান করত। কেননা চামড়ায় ঠিকমতো লবণ মাখালে তিন মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এ জন্যই আগামী রবিবার সব পক্ষকে আমরা ডেকেছি। তাদের কাছ থেকে সমস্যাগুলো শোনা হবে। এরপর সরকার-নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করা হবে।’ এদিকে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো টাকা ছিল না। কেননা ট্যানারিমালিকরা আমাদের আগের বকেয়াই পরিশোধ করেননি। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে পারেননি। এতে করে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ চামড়া কম সংগৃহীত হয়েছে, যা নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। সরকার-নির্ধারিত দাম নিয়ে ট্যানারিমালিকদের সঙ্গে আড়তদারদের এখনো দেনদরবার করতে হচ্ছে।’ অন্যদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেছেন, আগামী শনিবার থেকেই তারা কাঁচা চামড়া কিনবেন। তবে নানা সংকটের কারণে তারাও লোকসানে রয়েছেন। হঠাৎ দাম পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে ট্যানারিমালিকরা কিছু জানেন না। এ ছাড়া চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত দেশীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেশের বাজারে দাম পড়ে যাওয়ায় সরকার রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও তো চামড়ার দাম কমে গেছে।

আড়তদার ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, ট্যানারিমালিকরা আগের বকেয়া পরিশোধ করছেন না। উপরন্তু এ বছর সরকারের চাপে নির্ধারিত মূল্যে শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার কথা বললেও তারা ভিতরে ভিতরে এ বছরও বাকিতে চামড়া কেনার জন্য আড়তদারদের চাপ দিচ্ছেন। এ ছাড়া লবণ ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। ফলে চামড়ার গুণগত মান ঠিক নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের দাম কমছে অব্যাহতভাবে। এসব অজুহাত দেখিয়ে আগে থেকেই সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের ভিতরে ভিতরে চাপ দিয়ে আসছেন ট্যানারিমালিকরা। এদিকে বাড়তি মুনাফার লোভে ট্যানারির মালিকদের বেশির ভাগই সিন্ডিকেট করে কোরবানির পশুর চামড়া কিনছেন না। অল্প যা বিক্রি হয়েছে তা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কমে, নামমাত্র মূল্যে। এতে চামড়া সংগ্রহকারীরা বিপাকে পড়েন কোরবানির দিন। বিপুলসংখ্যক চামড়া পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ রাগে-ক্ষোভে বিপুলসংখ্যক চামড়া মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছে। এতে চলতি বছর অন্তত ৩০ শতাংশ কম চামড়া সংগৃহীত হয়েছে। এটি স্থানীয় বাজারের সংকটকে আরও তীব্র করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় আড়াই লাখের মতো পশু কোরবানি করা হয়েছে ঈদের দিন সোমবার। এ ছাড়া মঙ্গল ও বুধবার আরও ৩০ হাজারের মতো পশু কোরবানি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় দুই লাখের মতো পশু কোরবানি করা হয়েছে ঈদের দিন। এর পরের দুই দিনে আরও ৫০ হাজারের মতো পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। তিন বছর আগেও পাঁচ লাখ পশুর চামড়া গড়ে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাওয়া যেত। এই অর্থ মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিম ও গরিব মানুষদের দান করা হতো। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এবার রাজধানীতে চামড়াপ্রতি গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি দিতে রাজি হননি। ছাগলের চামড়া ১০ টাকার বেশিতে নিতে চাননি। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় মৌসুমি ক্রেতাদের না পাওয়ায় দামদর ঠিক না করেই আড়তদারদের চামড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে চামড়া বিক্রি বাবদ কত টাকা আসবে সে ব্যাপারে এখনো কিছুই জানেন না বিক্রেতারা। এ ছাড়া এখন সরকার-নির্ধারিত দামে ট্যানারিমালিকরা চামড়া কিনলেও সে টাকা যারা পাওয়ার কথা ছিল তারা পাবেন না। কেননা সংগৃহীত চামড়া তো এখন আড়তদারদের হাতে। ফলে সরকার-নির্ধারিত দামে ট্যানারিমালিকরা চামড়া কিনলেও তা এখন আড়তদার কিংবা বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের পকেটে চলে যাবে।

সর্বশেষ খবর